ছবি-সংগৃহীত
মতামত

বিশ্ব স্বীকার করুক পাকিস্তানিরা গণহত্যা চালিয়েছিল

মোস্তফা হোসেইন: ‘গণহত্যা’ শব্দটি ১৯৪৪ সালে প্রথম ব্যবহার করেন পোলিশ আইনজীবী রাফায়েল লেমকিন। গ্রিক শব্দ ‘genos’ অর্থাৎ জাতি বা উপজাতি এবং ল্যাটিন ‘caedere (cide)’ যার অর্থ হত্যা, শব্দ দুটি একত্রিত করে ‘genocide’ শব্দটি তৈরি করেছিলেন তিনি। সুতারাং জেনোসাইড শব্দের অর্থ হলো জাতি হত্যা। লেমকিনের এই সংজ্ঞাকেই প্রাধান্য দিয়ে অন্য সংজ্ঞাগুলো করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: এক মিনিট অন্ধকার থাকবে দেশ

জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালের গণহত্যা প্রতিরোধ ও শাস্তি সংক্রান্ত জাতিসংঘ কনভেনশন (UNPG) নিম্নোক্ত সংজ্ঞা প্রণয়ন করেছে।

গণহত্যা বলতে নিম্নলিখিতগুলির মধ্যে যে কোনো একটি অপরাধ কোনো জাতীয়, জাতিগত, ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে সংঘটিত হয়েছে:

(ক) দলের সদস্যদের হত্যা করা।
(খ) গ্রুপের সদস্যদের গুরুতর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করা।
(গ) ইচ্ছাকৃতভাবে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে শারীরিক ধ্বংস ঘটাতে আঘাত করা।
(ঘ) গ্রুপের মধ্যে জন্ম রোধ করার উদ্দেশ্যে ব্যবস্থা আরোপ করা।
(ঙ) গ্রুপের শিশুদের জোর করে অন্য গ্রুপে স্থানান্তর করা।

আরও পড়ুন: সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে

দেখা যাক পাকিস্তানি বাহিনী একাত্তরে এই দেশের সাধারণ মানুষের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছিল তাকে জেনোসাইডের স্বীকৃত সংজ্ঞা অনুযায়ী জেনোসাইড কিংবা গণহত্যা হিসেবে গণ্য করা যায় কি না।

বাঙালি জাতিকে সমূলে ধ্বংস করাই ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর উদ্দেশ্য। তারা সশস্ত্র নির্দিষ্ট কোনো পক্ষকেই হত্যা করেনি। তারা হত্যা করেছে, ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর বস্তিবাসীকে। তারা নৃশংসভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, গুলি করে, বোমা মেরে হত্যা করেছে গ্রাম ও শহরের নিরীহ সাধারণ মানুষ। এই নৃশংসতা ছিল একান্তই বাঙালি হওয়ার কারণে। এবং তাদের ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে।

দ্বিতীয় হচ্ছে- তারা বাঙালি মানে হিন্দু এমন সাম্প্রদায়িকতাকে লালন করেছে। বাঙালিকে তারা ‘মালাউন’ বলে তিরস্কার করে করে খুন করেছে। কিছুক্ষেত্রে পুরুষের যৌনাঙ্গ দেখেছে হিন্দু কি মুসলমান পরীক্ষা করতে। এটা সম্পূর্ণ একটা সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার কৌশল। গণহত্যার সংজ্ঞায় ধর্মীয় কারণে কাউকে ধ্বংস করে দেওয়াকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সুতরাং জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ীও পাকিস্তানি বাহিনী ১৯৭১ সালে গণহত্যা চালিয়েছে।

আরও পড়ুন: আ.লীগ নেতাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা

মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কিছু গোষ্ঠী এখনও পাকিস্তানিদের নৃশংসতাকে হালাল করার চেষ্টা করে যায়। তারা অন্তরে লালন করে পাকিস্তানি বাহিনী এই দেশে গণহত্যা চালায়নি। ঠুনকো যুক্তি হিসেবে তাদের বক্তব্য একাত্তরে ত্রিশ লাখ মানুষ খুন করেনি। এটা মিথ্যাচার। তাই তাদের গণহত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। তাদের বক্তব্যে দায়মুক্তির বিষয়টি সরাসরি না এলেও খুন হওয়া মানুষের সংখ্যায় বিতর্ক তৈরি করা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলার অপেক্ষা রাখে না।

ত্রিশ লাখ শহিদ হয়নি, তাদের এই যুক্তি যদি মেনেও নেয়া হয়, তাহলে প্রশ্ন আসে কতজনকে খুন করেছে পাকিস্তানি বাহিনী? ১০ লাখ,৫ লাখ,১ লাখ কিংবা ৩০ হাজার? কতজনকে হত্যা করেছে ওরা? সর্বনিন্ম সংখ্যার মানুষকেও যদি হত্যা করা হয়, তাহলে সেটা কি গণহত্যা নয়?

গোটা বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করার জন্য শুধু কি তারা অস্ত্র ব্যবহার করেছে? শুধু ১৯৭১ সালেই কি তাদের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত হয়েছিল? ইতিহাস সাক্ষী দেয়- দীর্ঘ পরিকল্পনা এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করতে করতে একাত্তর এসেছিল।

আরও পড়ুন: সিইসির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান

বাঙালি নাম মুছে ফেলার সব চেষ্টাই করেছে তারা। একটি উদাহরণ দেয়া যাক- ১৪ জুলাই ১৯৭১ ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এ প্রকাশিত সিডনি শনবার্গ এর একটি প্রতিবেদনের কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যায়- ‘বর্তমান সংবাদদাতা পাকিস্তানের পূর্ব প্রদেশে তার সাম্প্রতিক সফরকালে যা দেখতে পেয়েছেন এবং সেসব থেকে বোঝা যায় যে, পাকিস্তানের সামরিক সরকার ৭৫ মিলিয়ন জনগণের এই অঞ্চল পদানত রাখা ও তাদের দখলদারি বহাল রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ভঙ্গুর অর্থনীতি, সরকারি প্রশাসনের ভগ্নদশা, বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ক্রমবিস্তৃত গেরিলা তৎপরতা, সেনাবাহিনীতে হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি ও জনগণের সঙ্গে বর্ধমান ফারাক সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানিরা একগুঁয়ে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখছে। ..... দায়িত্বশীল পদে কোনো বাঙালির ওপরই তাদের আস্থা নেই, এমনকি ঢাকা বিমানবন্দরের ঘাস কাটে যে সেও অবাঙালি। বাঙালি ট্যাক্সি ড্রাইভারদের দেখা বিশেষ মেলে না। তাদের বদলে যারা পশ্চিম পাকিস্তাদের আধিপত্যাধনি সরকারের পক্ষ নিয়েছে এবং সেনাবাহিনীর বেসামরিক বাহু হিসেবে কাজ করে তাদের খবরাখবর ও মদদ জোগাচ্ছে।

পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষার ব্যবহার নিরুৎসাহিত করে তার পরিবর্তে উর্দু চালু করতে চাইছে। সৈনিকরা অবজ্ঞার সঙ্গে বাঙালিদের জানাচ্ছে তাদের ভাষা কোনো সভ্য ভাষা নয় এবং জীবনে কিছু করতে চাইলে তাদের উচিত হবে তাদের ছেলেমেয়েদের উর্দু শিক্ষাদান। ভীত ব্যবসায়ীরা বাংলার বদলে ইংরেজি সাইনবোর্ড বসাচ্ছে।’
(ডেটলাইন বাংলাদেশ নাইন্টিন সেভেনটিওয়ান, সিডনি শনবার্গ, মফিদুল হক অনূদিত,পৃষ্ঠা ৮৬-৮৭)

স্পষ্ট হয়ে যায়, কিছু মানুষ হত্যা করাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। তারা চেয়েছে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। যে কারণে বাংলা ও বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাসকেও ধ্বংস করতে চেয়েছে। বলতে গেলে ভাষা আন্দোলনের সময়কাল থেকে তারা যে ভূমিকা পালন করেছিল তারই সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে একাত্তরে বাংলাকে আক্রমণ করে তারা।

আরও পড়ুন: দুর্নীতিকে ঘৃণা করতে হবে

সুতরাং একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কিংবা যদি খণ্ডিত হলেও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পরিচালিত এই যুদ্ধ ছিল মূলত গণহত্যারই নামান্তর।

সঙ্গত কারণে প্রশ্ন আসে একাত্তরের গণহত্যাকে বিশ্বস্বীকৃতির বিষয়ে বাংলাদেশ কতটা ভূমিকা রেখেছে কিংবা কতটা সফল হয়েছে। জাতিসংঘের প্রসঙ্গেই আগে বলা দরকার। এই মুহূর্তে ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে জাতিসংঘ আর ঘোষণা করতে পারছে না, এটা প্রায় নিশ্চিতই বলা যায়। আমাদের দেশের উদ্যোগ না থাকার কারণেই এই সুযোগটি হাতছাড়া হয়ে গেছে। এরপর ব্যক্তি উদ্যোগ এবং রাষ্ট্রীয় কিছু উদ্যোগ মাঝে মাঝে চোখে পড়লেও কিছু সংগঠনের কিছু স্বীকৃতি আদায় করা গেছে। কিন্তু একাত্তরের নৃশংসতার আলোকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু স্বীকৃতি আসলে একাত্তরের ভয়াবহতাকে যথাযথ মূল্যায়ণ করে না। সরকারি আন্তরিক উদ্যোগ নেয়াটা খুবই জরুরি। এখনও একাত্তরের অনেক সাক্ষী জীবিত আছেন তাদের অবর্তমানে বিষয়টি আরও কঠিন হয়ে পড়বে।

লেখক: সাংবাদিক

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

জামায়াত-এনসিপি অসন্তুষ্ট

শুধু মাত্র একটি দলের সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করা...

তারেক- ইউনূসের যৌথ বিবৃতিতে নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হয়েছে- নাখোশ জামায়াত

তারেক- ইউনূসের যৌথ বিবৃতিতে নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করে জামায়াত। লন্...

ড্রয়ে ক্লাব বিশ্বকাপ শুরু মেসির মায়ামির

নতুন কিছু প্রযুক্তি সংযোজনের মাধ্যমে জমকালো উদ্বোধ...

ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়‌কে ১৪ কি‌লো‌মিটার জুড়ে যানজট

পবিত্র ইদুল আযহার ছুটি প্রায় শেষ। তাই সড়কগুলোতে যানবাহনের চাপ একটু বেশি। ঢাকা...

বান্দরবানে পর্যটকের মৃত্যু, ট্যুর এক্সপার্ট গ্রুপের প্রধান গ্রেপ্তার

বান্দরবানের আলীকদমে পর্যটক নিহতের ঘটনায় অনলাইনভিত্তিক ট্রাভেল গ্রুপ ‘ট্...

আর দেরি নয়, তামাক নিয়ন্ত্রণে এখনই পদক্ষেপ দরকার

জনস্বার্থে ন্যায্য ও সময়োপযোগী প্রস্তাবিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনে দেশের ত...

ইসির রোডম্যাপ অনুযায়ী প্রস্তুত থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

ইসি যে সময় ভোটের তারিখ ঘোষণা করবে সে সময়ের জন্য প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী&rs...

হঠাৎ উত্তপ্ত প্রেস ক্লাব, পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ

গণজমায়েতের নিষেধাজ্ঞা সত্বেও পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে মিছিল নিয়ে সচিবালয়ে প্রব...

যদি ইসরায়েল থামে তবে আমরাও থামবো: ইরান

ইরান-ইসরায়েল চলমান পাল্টাপাল্টি হামলায় মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছ...

ইসরায়েলের টার্গেট আয়াতুল্লাহ খামেনি: প্রতিবেদন

বিশ্ববাসির নজর এখন ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের দিকে; দুদেশকে নিয়ে চুলচেড়া বিশ্লেশন চ...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা