দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ও মৎস্যভান্ডার নামে খ্যাত বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে আবারও বেড়েছে দস্যু আতঙ্ক।
দস্যু বাহিনীর আত্মসমর্পণের কারণে কিছুদিন সুন্দরবনে স্বস্তি ফিরেছিল, বনজীবীরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে নতুন বনদস্যু বাহিনী।
গত ছয় বছর আগে আত্মসমর্পণকারী ও নতুনভাবে সংগঠিত দল মিলিয়ে অন্তত ২০টি দস্যু বাহিনী এখন সুন্দরবনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা, চাঁদপাই ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় তাদের দৌরাত্ম্য বেশি। এসব দস্যুরা জেলেসহ বনজীবীদের অপহরণ করে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করছে।
গত তিন মাসে তিন শতাধিক জেলে অপহৃত হয়েছেন, মুক্তিপণ হিসেবে আদায় করা হয়েছে লাখ লাখ টাকা। এতে জেলে, বনজীবী ও ব্যবসায়ীরা চরম আতঙ্কে রয়েছেন। দ্রুত যৌথ অভিযান চালিয়ে বনদস্যুদের দমন করার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
মৎস্য ব্যবসায়ী ও জেলেদের সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যাওয়া তিন শতাধিক জেলে বনদস্যুদের হাতে অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গত সেপ্টেম্বরেও শতাধিক জেলেকে জিম্মি করে বনদস্যুরা মুক্তিপণ আদায় করেছে। অনেকেই গোপনে টাকা পরিশোধ করে ফিরে এসেছেন। এখনও বিভিন্ন বাহিনীর হাতে বেশ কয়েকজন জেলে জিম্মি আছেন বলে জানিয়েছেন মৎস্য ব্যবসায়ীরা।
পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের মরা ভোলা, আলী বান্দা, ধঞ্চে বাড়িয়া, তেঁতুলবাড়িয়া, টিয়ার চর, আন্ধারমানিক, পশুর ও শিবশা এলাকায় জলদস্যুদের বিচরণ বেশি। দস্যুরা বিভিন্ন নামে দল গঠন করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। আগের আত্মসমর্পণকারী ও বিভিন্ন মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে নতুন বাহিনী।
এসব বাহিনীর মধ্যে জাহাঙ্গীর বাহিনী, মনজুর বাহিনী ও দাদা ভাই বাহিনী অস্ত্র ও সদস্যসংখ্যায় সবচেয়ে শক্তিশালী। এই তিন বাহিনীর সদস্যরা আগে আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছিল। এ ছাড়া করিম-শরীফ বাহিনী, আসাদুল বাহিনী, দয়াল বাহিনী, রবি বাহিনী, দুলাভাই বাহিনী, রাঙ্গা বাহিনী, সুমন বাহিনী, আনোয়ারুল বাহিনী, হান্নান বাহিনী ও আলিফ বাহিনীর নামও উল্লেখযোগ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বনসংলগ্ন এলাকার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি দস্যুদের মধ্যস্থতাকারী ও সোর্স হিসেবে কাজ করছেন। তারা অপহৃত জেলেদের পরিবার ও মহাজনদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করে মুক্তিপণের টাকা আদায় করে দস্যুদের হাতে পৌঁছে দেন।
বিভিন্ন দস্যু বাহিনী নিজস্ব সংকেত-সংবলিত “টোকেন” দিচ্ছে জেলেদের। এই টোকেন সঙ্গে রাখলে সুন্দরবনে মাছ ধরার সময় তারা নিরাপদ থাকেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে শরণখোলার একাধিক মাছ ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, দস্যুদের বিরুদ্ধে কথা বলা নিরাপদ নয়। বনসংলগ্ন আড়ত এলাকায় দস্যুদের প্রতিনিধি বা সোর্স নিয়মিত ঘোরাফেরা করে। কেউ তথ্য ফাঁস করলে পরে বনে গেলে নির্যাতন ও চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যায়।
ব্যবসায়ীদের ভাষ্য অনুযায়ী, বনে জেলে পাঠাতে প্রতি নৌকায় ২৫–৩০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয় এবং অপহরণের পর মুক্তিপণ হিসেবে দিতে হয় ৪০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা।
তবে কোস্টগার্ডের সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এতে দস্যু বাহিনীর তৎপরতা কিছুটা কমেছে এবং উপকূলের বনজীবীদের মাঝে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে।
বন বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র বলছে, সুন্দরবনের বনদস্যুরা কয়েক দফায় আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার অঙ্গীকার করেছিল।
২০১৬ সালে সাতটি বনদস্যু দল একযোগে আত্মসমর্পণ করে— ৩২ জন বনদস্যু অস্ত্র জমা দেন। এরপর ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর ৯টি বাহিনীর ৫৭ জন, এবং ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর আরও ২৫ জন আত্মসমর্পণ করেন। ফলে সুন্দরবন প্রায় দস্যুমুক্ত হওয়ার পথে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনাগুলো নতুন বনদস্যু বাহিনীর উত্থানকেই নির্দেশ করছে।
সূত্র জানায়, গত তিন মাসে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ২০ জনেরও বেশি জেলে ও মৌয়াল অপহৃত হয়েছেন। তাদের কাছে মুক্তিপণের দাবি করা হয়েছে ১০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত। তবে কোস্টগার্ডের কয়েকটি অভিযানে অনেক জেলে উদ্ধারও হয়েছে।
কোস্টগার্ড মংলা পশ্চিম জোনের একটি সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকেই সুন্দরবনে দস্যুদের উৎপাত শুরু হয়। এরপর থেকে নিয়মিত ও বিশেষ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।
গত ৩ অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় ২৭টি অভিযান চালিয়েছে কোস্টগার্ড। এসব অভিযানে রাঙ্গা বাহিনীর প্রধানসহ ৪৪ জন বনদস্যু ও সহযোগীকে আটক করা হয়। উদ্ধার করা হয় ৪০টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৪৩টি দেশীয় অস্ত্র, ১৭০ রাউন্ড তাজা কার্তুজ ও ৩৬৯টি ফাঁকা কার্তুজ। এছাড়াও অস্ত্র তৈরির বিপুল সরঞ্জামও উদ্ধার করা হয়।
বনদস্যুদের হাতে জিম্মি থাকা ৪৮ জন জেলেকে উদ্ধার করে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক বনজীবী জানিয়েছেন, বর্তমানে বিভিন্ন নামে নতুন বনদস্যু বাহিনী গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে করিম-শরীফ বাহিনী, দয়াল বাহিনীসহ অন্তত ৫–৭টি ডাকাত দল সক্রিয়। নৌকায় করে এরা সুন্দরবনের গহীনে অবস্থান নেয় এবং সুযোগ বুঝে মাছ ধরার ট্রলার ও বনজীবীদের অপহরণ করে। অপহরণের পর ডেরায় নিয়ে চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন।
এক অপহৃত জেলে বলেন,“সুন্দরবনের সক্রিয় দস্যু বাহিনীর মধ্যে দয়াল বাহিনী সবচেয়ে দুর্ধর্ষ। তারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ট্রলারে হামলা করে। মুক্তিপণের টাকা না দিলে ভয়াবহ নির্যাতন চালায়— এমনকি হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দিতেও দ্বিধা করে না।”
সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, “দস্যুরা সাধারণত জেলে বা মৌয়ালের ছদ্মবেশে সুন্দরবনে প্রবেশ করে দস্যুতায় জড়িয়ে পড়ে। এদের একটি ডাটাবেজ তৈরি করে ডিজিটালভাবে শনাক্ত করা জরুরি। যাতে সহজে তাদের চিহ্নিত ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি ও পরিবারের ওপর পর্যবেক্ষণ বাড়াতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “সুন্দরবনের বিভিন্ন পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল ও নজরদারি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বনজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। সুন্দরবনের নিরাপত্তা শুধু আইনশৃঙ্খলার বিষয় নয়— এটি অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সংকটের দিকেও ইঙ্গিত করছে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে প্রাকৃতিক সম্পদ ও নির্ভরশীল মানুষের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।”
এদিকে গত ১০ এপ্রিল সুন্দরবনের গহীন এলাকা থেকে বনদস্যু করিম-শরীফ বাহিনীর জিম্মি থেকে ৬ নারীসহ ৩৩ জেলেকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। এর আগেও অস্ত্রসহ কয়েকজন দস্যুকে গ্রেপ্তার করা হয়।
কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন সদর দপ্তরের মিডিয়া কর্মকর্তা লে. মাহবুব হোসেন বলেন, “বিগত দিনে যেমন সুন্দরবনে দস্যুতা দমনে কোস্টগার্ড তৎপর ছিল, বর্তমানে এবং ভবিষ্যতেও সেই তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।”
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ বাগেরহাটের বিভাগীয় কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “সুন্দরবনে দস্যুদের তৎপরতায় শুঁটকি মৌসুমে দুবলাসহ বিভিন্ন চরে ৮ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।”
সুন্দরবনের খুলনা বিভাগীয় বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, “সুন্দরবন সুরক্ষায় বন বিভাগের দায়িত্ব অপরিসীম। বাঘ, হরিণসহ সব বন্যপ্রাণী রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। তবে দস্যু দমনে র্যাব ও কোস্টগার্ডের ওপর সরকার দায়িত্ব দিয়েছে। আমরা তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি।”
সাননিউজ/আরপি