বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত দীর্ঘদিন ধরে নানা সংকট ও চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। হাসপাতালে রোগীর সেবা গ্রহণ করতে গিয়ে যে ভোগান্তির মুখোমুখি হতে হয়, তা কেবল ব্যক্তিগত সমস্যা নয়; এটি একটি সামাজিক সংকট। দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় বেডের অভাব, প্রশিক্ষিত জনবল সংকট এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির স্বল্পতা স্বাস্থ্যসেবাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগীরা প্রায়ই দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে বাধ্য হন। হাসপাতালের ভেতর জায়গা না থাকায় অনেক রোগীকে মেঝেতে বা বারান্দায় শুয়ে থাকতে দেখা যায়, আর স্বজনদের রাতভর হাসপাতালের বাইরে কাটাতে হয়। বিশেষ করে ক্যান্সার, কিডনি বা হৃদরোগের মতো জটিল রোগের চিকিৎসায় এই সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠছে।
হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে গেলে লবিং, দালালি এবং প্রভাবের ব্যবহার আজ এক অনিবার্য বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই রোগী বা তার পরিবারের সদস্যদের অতিরিক্ত খরচ করতে হয়, যা কখনও ঘুষের আকারে, আবার কখনও সুপারিশ ও পরিচিতির মাধ্যমে সুবিধা আদায়ে ব্যবহৃত হয়। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি থেকে শুরু করে চিকিৎসা পাওয়ার প্রতিটি ধাপে এই অনিয়ম স্পষ্ট। শুধু রোগী নয়, ডাক্তার ও নার্সদের নিয়োগ, যন্ত্রপাতি ক্রয়, ওষুধ সরবরাহ এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও ঘুষ ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে। ফলে দক্ষ জনবল ও আধুনিক যন্ত্রপাতির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
সরকারি মেডিসিন বা বিনামূল্যে দেওয়া ওষুধ পেতে গেলেও রোগীদের প্রায়শই হয়রানির শিকার হতে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, সরকারি স্টোরে ওষুধ থাকা সত্ত্বেও রোগীরা তা পাচ্ছেন না, অথচ একই ওষুধ বাইরে উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে। এসব অনিয়মের পেছনে একটি অদৃশ্য সিন্ডিকেট কাজ করছে, যারা সরকারি সরবরাহ ব্যবস্থাকে নিজেদের স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করে।
এই দীর্ঘমেয়াদি অব্যবস্থা কেবল রোগীদের শারীরিক কষ্টই বাড়াচ্ছে না, বরং তাদের মানসিক ও আর্থিক চাপকেও বহুগুণে বাড়িয়ে তুলছে। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা, চিকিৎসা বিলম্ব, সঠিক পরামর্শ না পাওয়া এবং চিকিৎসা ব্যয়ের বোঝা, সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ চক্রে পড়ছে সাধারণ মানুষ। বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নত যন্ত্রপাতি ও মানবসম্পদ থাকলে দেশের ভেতরেই ক্যান্সার ও জটিল রোগের চিকিৎসা সম্ভব, কিন্তু প্রশাসনিক অনিয়ম, যন্ত্রপাতির অকেজো অবস্থা এবং পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা বাস্তবে সম্ভব হচ্ছে না।
অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর কবির উল্লেখ করেছেন, “ক্যান্সার চিকিৎসায় আমাদের সক্ষমতা আছে, কিন্তু যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণ ও সঠিক ব্যবহারে ঘাটতি রয়ে গেছে। ফলে অনেক রোগী দেশেই চিকিৎসা না পেয়ে বিদেশে যাচ্ছেন, যা অর্থনৈতিকভাবে দেশের জন্যও ক্ষতির।” একইসঙ্গে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের ভাষায়, “আমাদের সিস্টেম ভেঙে নতুনভাবে গড়তে হবে, নইলে আমরা একই ভুলের ভেতরেই ঘুরপাক খেতে থাকব।”
স্বাস্থ্য খাতের এই সমস্যাগুলোর মূলে রয়েছে প্রশাসনিক জটিলতা, নীতিগত দুর্বলতা এবং জবাবদিহির অভাব। অনেক সময় নীতি প্রণয়ন করা হলেও তার বাস্তবায়নে আন্তরিকতা দেখা যায় না। উপরন্তু, বাজেট বরাদ্দ যথেষ্ট না হওয়ায় উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলো আধুনিকীকরণের সুযোগ পায় না। দেশের মোট স্বাস্থ্য বাজেট এখনো জিডিপির ১ শতাংশের নিচে, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম।
নিরপেক্ষভাবে বলা যায়, স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার এখন সময়ের দাবি। কার্যকর ও সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে নীতিমালার পাশাপাশি বাস্তবায়ন পর্যায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত বেড, প্রশিক্ষিত জনবল, আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং ওষুধের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি, জনসচেতনতা বাড়ানো, দুর্নীতি ও লবিং কমানো, এবং ডিজিটাল মনিটরিং ব্যবস্থার মাধ্যমে সেবা প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে।
যুগোপযোগী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য শুধুমাত্র সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট নয়; সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যকর্মী, নাগরিক ও গণমাধ্যমের সম্মিলিত ভূমিকা অপরিহার্য। সবার দায়িত্ববোধ ও অংশগ্রহণ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতের এই অচলাবস্থা থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, একটি মানবিক ও জবাবদিহিমূলক সেবা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে রোগী থাকবে কেন্দ্রবিন্দুতে, আর দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা থাকবেন জবাবদিহির আওতায়। সিন্ডিকেট, অনিয়ম ও অব্যবস্থা দূর করতে পারলেই বাংলাদেশ একদিন সত্যিকার অর্থে “সবার জন্য স্বাস্থ্য” বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হবে।
তথ্যসূত্র: ACE Working Paper: Bangladesh Health System Irregularities IJCM & PH: Cancer treatment in Bangladesh Equity in Health Journal