বাংলাদেশে প্রতিদিন কোটি মানুষের রান্নাঘরে ব্যবহার হচ্ছে সয়াবিন ও পাম তেল। কিন্তু সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে এসেছে ভয়াবহ তথ্য- এই তেলেই লুকিয়ে আছে মানবদেহের জন্য মারাত্মক এক বিষ, মার্কারি (Mercury)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাজমা শাহীন নেতৃত্বে পরিচালিত ওই গবেষণায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সংগৃহীত ১,৫২১টি সয়াবিন ও পাম তেলের নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়। ফলাফলে দেখা যায়, সয়াবিন তেলে মার্কারি পাওয়া গেছে সহনীয় মাত্রার ১৭ থেকে ২০ গুণ বেশি, আর পাম তেলে ৬ থেকে ১৪ গুণ বেশি। এই মাত্রা আন্তর্জাতিকভাবে নির্ধারিত নিরাপদ সীমার অনেক ওপরে। গবেষক দল আরও চারটি হেভিমেটাল- আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম ও লেড- পরীক্ষা করলেও সেগুলোর মাত্রা তুলনামূলকভাবে স্বাভাবিক পাওয়া যায়। কিন্তু মার্কারির অস্বাভাবিক উপস্থিতি জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুযায়ী, মার্কারি মানবদেহের জন্য অন্যতম বিপজ্জনক রাসায়নিক। এটি শরীরে জমে গিয়ে স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি, কিডনির বিকলতা, হৃদযন্ত্র ও রক্তনালীর ক্ষয়, এবং শিশুদের মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। দীর্ঘমেয়াদে কম মাত্রার এক্সপোজারও স্নায়বিক অবক্ষয়, স্মৃতিভ্রংশ ও মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণ হতে পারে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ২০–৪০ বছর বয়সীদের মধ্যে হঠাৎ হৃদরোগ ও কিডনি জটিলতার বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। যদিও এর সরাসরি সম্পর্ক নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা নেই, তবুও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যে থাকা ভারী ধাতু এর একটি প্রধান গোপন কারণ হতে পারে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই গবেষণার ফলাফল আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার পরও BSTI, Bangladesh Food Safety Authority বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। কোনো ব্র্যান্ডের তেল বাজার থেকে প্রত্যাহার বা সতর্কতা বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশিত হয়নি। গণমাধ্যমে বিষয়টি তেমনভাবে আলোচিত না হওয়ায় সাধারণ মানুষ এই বিপদের খবরও জানে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নীরবতা ভোক্তা অধিকার, খাদ্যনিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্যের প্রতি সরকারের দায়িত্বহীনতার প্রতিফলন।
মার্কারি কেবল এক উদাহরণ। বাংলাদেশে খাদ্য ভেজালের পরিমাণ এতটাই প্রকট যে, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর অনুযায়ী বাজারে পাওয়া পণ্যগুলোর প্রায় ৪০% কোনো না কোনোভাবে মানহীন বা ভেজাল। দুধে ফরমালিন, ফল ও সবজিতে কার্বাইড ও কীটনাশক, মাছে ক্ষতিকর প্রিজারভেটিভ, এমনকি লবণেও কখনো আর্সেনিক- সব মিলিয়ে একটি অঘোষিত ‘বিষ-অর্থনীতি’ গড়ে উঠেছে। এই বাস্তবতায় তেল দূষণ কেবল একটি আলাদা সমস্যা নয়, বরং একটি সামগ্রিক খাদ্য সংকটের অংশ, যা বছরের পর বছর ধরে চলছে নীরবে।
বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন: ভোজ্য তেলে হেভিমেটাল টেস্ট বাধ্যতামূলক করা, প্রতিটি ব্যাচ বাজারজাতের আগে BSTI অনুমোদিত পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা, Synthetic bleaching clay নিষিদ্ধ করে তার পরিবর্তে natural earth-grade clay ব্যবহারের বিধান করা, প্রতি মাসে র্যান্ডম স্যাম্পল পরীক্ষা করে জনসম্মুখে প্রকাশ করা, জনগণকে সচেতন করা যে ব্র্যান্ড মানেই নিরাপদ নয়, এবং স্থানীয় গবেষণায় সরকারি তহবিল বৃদ্ধি করা।
বাংলাদেশে খাদ্য ভেজাল এখন আর কোনো মৌসুমি বা বিচ্ছিন্ন সমস্যা নয়; এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার প্রতিফলন। নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতা, ব্যবসায়ী প্রভাব, এবং গণমাধ্যমের নীরবতা এই সংকটকে আরও গভীর করছে। প্রতিদিন আমরা রান্নায় যে তেল ব্যবহার করছি, তা যদি মার্কারির মতো বিষাক্ত ধাতুতে ভরা হয়, তবে এটি শুধু একটি স্বাস্থ্য সমস্যা নয়- এটি একটি প্রজন্মগত বিপর্যয়। খাদ্য নিরাপত্তা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এই গবেষণা সেই সত্য আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। এখন দায়িত্ব সরকারের, গণমাধ্যমের, এবং নাগরিক সমাজের- যাতে বাংলাদেশের খাদ্যতেল নিরাপদ হয়, আর আমাদের খাদ্য আর বিষ না থাকে।
সাননিউজ/এও