ঢাকা ও আশপাশে সাম্প্রতিক চারটি ভূমিকম্প রাজধানীর বড় বিপদের সংকেত আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের ঢাকার নিকটবর্তী অবস্থান, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দুর্বল ভবন কাঠামো ও অতিরিক্ত জনঘনত্ব—সব মিলিয়ে একটি বড় বিপর্যয়ের সম্ভাবনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞরা। গত শুক্রবার সকালে নরসিংদীর মাধবদী এলাকায় রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প ছিল স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে তীব্রগুলোর একটি। ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে উৎপন্ন হওয়ায় ঝাঁকুনিটা ছিল ভয়াবহ, যা ঢাকাসহ দেশের বিস্তৃত অঞ্চলে অনুভূত হয়। এতে নিহত হয়েছেন শিশুসহ অন্তত ১০ জন এবং আহত হয়েছেন ৬ শতাধিক মানুষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কম গভীরতার ভূমিকম্প ইঙ্গিত দিচ্ছে যে নরসিংদীর সাব–ফল্ট আগে যতটা ছোট বলে ধারণা করা হয়েছিল, প্রকৃতপক্ষে তা অনেক বড় এবং ঢাকার দিক পর্যন্ত বিস্তৃত। গতকাল আরও তিনটি ভূমিকম্প হয়—দুটির উৎস নরসিংদী এবং একটির উৎস ঢাকার বাড্ডা। ফলে এই পুরো অঞ্চলে ভূ-অভ্যন্তরে চাপ সঞ্চয় ও শক্তি নির্গমনের প্রবণতা বাড়ছে, যা বড় একটি ভূমিকম্পের সম্ভাবনাকে আরও ঘনিষ্ঠ করে তুলছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের গত পাঁচ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের ভেতরে রেকর্ড হওয়া ৩৯টি ভূমিকম্পের মধ্যে ১১টির উৎপত্তিস্থল ঢাকার ৮৬ কিলোমিটারের মধ্যে। এটি স্পষ্টভাবে দেখায় যে ঢাকার আশপাশের ফল্ট জোনগুলো আগের তুলনায় আরও সক্রিয় হয়ে উঠছে। নরসিংদী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, দিনাজপুর, পাবনাসহ ১৮টি জেলায় এই সময়ে ভূমিকম্প হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর বড় অংশই মধ্য ও পূর্বাঞ্চলের ফল্ট লাইনে সক্রিয়তার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
একই সঙ্গে দেখা গেছে, ভূমিকম্পের বেশির ভাগই ঘটেছে রাতের সময়ে—সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টার মধ্যে ২৩টি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাতে মানুষ ঘুমিয়ে থাকায় বা ঘরের ভেতরে অবস্থান করায় প্রাণহানির ঝুঁকি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ভূমিকম্পের পর আলোকসজ্জা, উদ্ধারকাজ ও দ্রুত সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে ক্ষয়ক্ষতিও সাধারণত বেশি হয়।
বুয়েটের অধ্যাপক রাকিব হাসান ঢাকার ঝুঁকি বাড়ার চারটি কারণ উল্লেখ করেছেন—ঢাকার নিকটবর্তী সক্রিয় ফল্ট লাইন, নিচু জমি ভরাট করে গড়ে ওঠা অঞ্চলের মাটির দুর্বল গঠন, নির্মাণ বিধি না মেনে ভবন নির্মাণ এবং চরম জনঘনত্ব। তাঁর মতে, এই চারটি কারণ একসঙ্গে কাজ করলে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পও ঢাকায় ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
অন্যদিকে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকরা। ২০১৬ সালে ভূমিকম্প মোকাবিলায় ন্যাশনাল অপারেশন সেন্টার নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হলেও এক দশক পরও তা বাস্তবায়ন হয়নি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর জানিয়েছে, সরঞ্জাম সংগ্রহ ও স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত করার কাজ চলছে, তবে এখনও যথাযথ প্রস্তুতি কার্যকরভাবে নিশ্চিত করা যায়নি। স্থানীয় সরকারকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় যুক্ত না করা ও তথ্য আদান–প্রদানে ধীরগতি থাকাকে বড় দুর্বলতা হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমিকম্প নিয়ে সচেতনতার ঘাটতিও বড় একটি সমস্যা। সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে বিভিন্ন ছাত্রাবাস থেকে শিক্ষার্থীরা আতঙ্কে নিচে লাফিয়ে পড়েছেন—যা প্রশিক্ষণ ও সচেতনতার অভাবের স্পষ্ট উদাহরণ। ভূমিকম্প বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকায় সাধারণ মানুষ জানেন না কীভাবে নিরাপদ থাকতে হয়।
সব মিলিয়ে, ঢাকা এখন ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। গভীর ভূকম্পন সক্রিয়তা, ঘনবসতি, দুর্বল নির্মাণব্যবস্থা ও অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি—সবকিছুই একটি বড় দুর্যোগের পূর্বাভাস দিচ্ছে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই কঠোর উদ্যোগ, সুদৃঢ় প্রস্তুতি ও জনসচেতনতা ছাড়া সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব নয়।
সাননিউজ/এও