বসতবাড়ির পাশে প্রায়ই দেখা যায় টকপাতা। পাতা ও ফল টক স্বাদযুক্ত গাঢ় লাল বর্ণের। এটি উপগুল্মজাতীয় উদ্ভিদ, যার ইংরেজি নাম Rosella বা Sorrel, বৈজ্ঞানিক নাম Hibiscus sabdariffa, যা বাংলাদেশের মানুষের কাছে টকপাতা, চুকাই এবং হরপাতা নামে বেশ পরিচিত।
বৈজ্ঞানিকভাবে এটিকে ফল বা ফুল বলা হলেও এটি অপ্রকৃত ফল। বৃতি এর ভক্ষণযোগ্য অংশ, যা খুবই পাতলা এবং পরিমাণে অল্প; গর্ভাশয় বড় এবং ছোট ছোট হুলযুক্ত। ভক্ষণযোগ্য অংশটি গর্ভাশয়কে ঘিরে থাকে। পরিপক্ব গর্ভাশয়ে অনেকগুলো বীজ থাকে, যা বিদারী ফল। অর্থাৎ পাকলে এটি ফেটে যায় এবং বীজ ছড়িয়ে যায়।
এক সময় গ্রাম অঞ্চলে এই টকপাতা/চুকাই ফলের গাছ দেখা যেত। এখন কালের বিবর্তনে প্রায় বিলুপ্তির পথে জনপ্রিয় এ ফলগাছ। বাণিজ্যিকভাবে চাষ না হলেও খাগড়াছড়ির পাহাড়ি এলাকার প্রায় বাড়িতেই এই গাছ পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সবজি চাষের পাশাপাশি টকপাতা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে সম্ভাবনাময় ফসল হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। স্বল্প পরিশ্রমে ভেষজ গুণের নিশ্চয়তার পাশাপাশি সবজি হিসেবে উৎপাদন করে বেকার যুবক/মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ ও বাড়তি মুনাফা অর্জন করা সম্ভব হবে।
বিশ্বের প্রায় দেশে এই ফলের বাণিজ্যিকভাবে চাষ হলেও বাংলাদেশে হয় না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের পতিত অনাবাদি জমি বা পরিত্যক্ত জায়গায় যদি চুকাই চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা যায়, তাহলে সবজি হিসেবে এটি একটি সম্ভাবনাময় ফসল হয়ে উঠতে পারে। এ-ছাড়াও বিদেশে টকপাতা/চুকাই-এর প্রচুর চাহিদা থাকায় এর থেকে উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্য, এমনকি শুকনা বীজ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
পার্বত্য এলাকার প্রায় বাড়িতে এই গাছ পাওয়া যায়। যদিও অনেক অঞ্চল থেকে এটি এখন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, মহালছড়ি, লক্ষীছড়ি, পানছড়ি, গুইমারা ও মাটিরাঙায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ না হলেও পাহাড়ি এলাকায় এই টকপাতা/চুকাই গাছ রয়েছে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এটি বিভিন্ন নামে পরিচিত—যেমন চট্টগ্রামে খরঅগুলা, সিলেটে হইলফা, খুলনায় অম্বলমধু, ঢাকায় চুকুল, কুমিল্লায় মেডস নামে পরিচিত।
উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞদের মতে, সমতল ভূমির চেয়ে পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় এই গাছ বেশি জন্মায়। তাছাড়া এই ফলটি পাহাড়িদের জনপ্রিয় খাবার। পাহাড়ে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতি এই ফলটি নিজেদের আঙিনা বা বাড়ির আশপাশে রোপণ করে থাকেন। পাটজাতীয় এই ফলটি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবার তৈরি করেন পাহাড়ি অধিবাসীরা।
টকপাতার জনপ্রিয়তাও ফলের মতোই সমান। এটি শুধু ফলই নয়—খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি ব্যাপক ভেষজ গুণের অধিকারী। মানবদেহের বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে এর কার্যকারিতা অপরিসীম। টকপাতা/চুকাই পাতা ও ফলে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান রয়েছে। এর পাতার ভেষজ চা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, মূত্রবর্ধক, মৃদু কুষ্ঠ নরমকারী, হৃদরোগ, ক্যান্সার ও স্নায়ুরোগের চিকিৎসায় দীর্ঘকাল ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
তাছাড়াও টক স্বাদের কারণে জ্যাম, জেলি ও আচার তৈরিতে এই ফল ব্যবহার করা হয়। এই গাছের আঁশকে পাটের আঁশের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাণিজ্যিকভাবে চাষ করলে সম্ভাবনাময় একটি খাতে পরিণত হতে পারে এই টকপাতা/চুকাই। এর থেকে উৎপাদিত চা, মেস্তা-স্বত্ব, জ্যাম, জেলি, জুস, আচার, বীজ থেকে ২০% ভোজ্যতেল বাজারজাত করা গেলে পাল্টে যাবে দেশের অর্থনীতি। বিশেষ করে খাগড়াছড়ির পার্বত্য অঞ্চলে এই শিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নাসির উদ্দীন চৌধুরী বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ হলেও বাংলাদেশে টকপাতার চাষ হয় না। তবে এটি ঔষধী গুণে ভরপুর। আমাদের দেশে প্রায় বিলুপ্তির পথে এই গাছটি।
সাননিউজ/আরপি