বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে গড়ে ওঠা ঐতিহাসিক নিদর্শন রবার্ট মোরেলের ইংরেজ নীলকুঠি কুঠিবাড়ি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
অবহেলা আর সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ না থাকায় দেড়শ’ বছর আগের এ নিদর্শন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। রহস্যে ঘেরা আর কালের সাক্ষী কুঠিবাড়ির অস্তিত্ব বিলুপ্তির পথে। ১৮৪৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি মিসেস মোরেল তার দুই ছেলে রবার্ট মোরেল ও হেনরি মোরেলের নামে এ অঞ্চলের পত্তনি গ্রহণ করেন এবং পানগুছি ও বলেশ্বর নদীর মোহনায় সুন্দরবন বন্দোবস্ত নিয়ে বন আবাদ করে বসতি গড়ে নীলচাষ শুরু করেন।
বরিশাল থেকে শ্রমিক সংগ্রহ করে বন আবাদ করে গড়ে তোলেন বিশাল আবাসস্থল ‘কুঠিবাড়ি’। নির্মাণ করা হয় আস্তাবল, পিলখানা, নাচঘর, গুদামঘর, কাচারিবাড়ি, লাঠিয়াল বাহিনীর জন্য পৃথক ঘর এবং নির্যাতন কক্ষ। সুন্দরবনের হিংস্র প্রাণী ও রয়েল বেঙ্গল টাইগারের হাত থেকে রক্ষা পেতে কুঠিবাড়ির চতুর্দিকে সুউচ্চ প্রাচীর নির্মাণ করা হয়।
এ কুঠিবাড়িটি দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে ভূমি অফিসের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছিল। ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণার পরও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে দীর্ঘ কয়েক বছর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কার্যক্রম চলেছে। বর্তমানে এ ঐতিহাসিক ইংরেজ নীলকুঠি সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। শুধু কালের সাক্ষী হয়ে এখনও রয়েছে ‘কুঠিবাড়ি’ নামে পরিচিত মোরেলদের ‘নীলকুঠি’র ধ্বংসাবশেষ। ‘কুঠিবাড়ি’ ভবনের পুরোনো আমলের সেই দরজা, জানালা, গ্রিল, সিন্দুক, সিঁড়িসহ বহু মূল্যবান মালামাল ধীরে ধীরে বেহাত হয়ে গেছে। স্মৃতিস্তম্ভ থেকেও চুরি হয়ে গেছে অনেক মালামাল।
কোনো সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে সংরক্ষণের স্পর্শ না পেয়ে ইতিহাসের এই মহামূল্য স্মৃতিচিহ্ন ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
কৃষক নেতা রহিমুল্লার অবিস্মরণীয় বিদ্রোহ:
নীলকরের অত্যাচার বাড়তে থাকলে এর বিরুদ্ধে দাঁড়ান সুন্দরবনের কৃষক নেতা রহিমুল্লা। কলকাতা থেকে ইংরেজি শেখার চেষ্টা ছেড়ে তিনি গ্রামে ফিরে আসেন এবং ভাইদের নিয়ে ১৪ শ’ বিঘা জমি আবাদ করেন। খবর পেয়ে রবার্ট মোরেল খাজনা দাবি করলে রহিমুল্লা তা প্রত্যাখ্যান করেন। পুনরায় খাজনা চাইতে পিয়াদা পাঠানো হলে তিনি কাঠের বাক্সে ছেঁড়া জুতা পাঠিয়ে জানান দেন তাঁর প্রতিবাদ।
কূটচালে মোরেল রহিমুল্লার সহযোগী গুণী মামুনকে পত্তনি দেন এবং ১৮৬১ সালের ২১ নভেম্বর রাতে শতাধিক লাঠিয়াল নিয়ে রহিমুল্লাকে আক্রমণ করেন। পাল্টা লড়াইয়ে মোরেল বাহিনীর রামধন মালোসহ ৭–৮ জন নিহত হয়। হেনরি মোরেল ও ম্যানেজার হেইলি ধরা পড়ে রহিমুল্লার হাতে। অনুতাপ প্রকাশ করলে তাঁদের ছেড়ে দেন তিনি।
তবে তিন দিন পর, ২৫ নভেম্বর রাতে অস্ত্রসজ্জিত বাহিনী নিয়ে আবারও আক্রমণ করে মোরেল পরিবার। দুই স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সারা রাত লড়াই করেন রহিমুল্লা। ভোরের আলো ফুটতেই গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি শহীদ হন।
মোরেলদের পতন ও স্মৃতিস্তম্ভ:
রহিমুল্লা হত্যার জের ধরে ১৮৭৮ সালে মোরেল পরিবার গুটিয়ে নেয় তাদের শাসন। তবে তাদের নির্মাণ—‘কুঠিবাড়ি’—আজও দাঁড়িয়ে আছে সময়ের নীরব সাক্ষী হয়ে। ইংরেজ অপশাসকের স্মরণে তাঁদের অনুসারীরা নির্মাণ করেছিলেন একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যার সাদা পাথরে খোদাই করা আছে রবার্ট মোরেলের মৃত্যুবার্তা ও নির্মাতাদের নাম।
ঐতিহ্যবাহী এই কুঠিবাড়ি নিয়ে গবেষক প্রাক্তন অধ্যক্ষ ম্যাটস বাগেরহাট ডা. মো. শিব্বির আহমেদ বলেন, কুঠিবাড়ি একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। এটি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ইতিপূর্বে অনেক জমি অবৈধ দখলদারের হাতে চলে গেছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষণ করে দেখভালের দায়িত্ব গ্রহণের দাবি জানান তিনি। পাশাপাশি কুঠিবাড়ির এ জমিতে শিশু পার্ক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে শিশুদের বিনোদনের চাহিদা লাঘব হবে। আয়ের উৎস থেকে সরকারিভাবে রাজস্বও আসবে।
মোরেলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার হাবিবুল্লাহ জানান, কুঠিবাড়ি সংরক্ষণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া এখানে বিনোদন কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনাসহ দৃষ্টিনন্দন করতে কৃষ্ণচূড়া গাছ রোপণ করা হবে।
মোরেলগঞ্জের ইতিহাসের সূতিকাগার হিসেবে কুঠিবাড়িটি সংরক্ষণের জন্য ইতিমধ্যে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। ইতিহাস–ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারিভাবে বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে। ঐতিহাসিক এ ইংরেজ শাসনামলের ‘কুঠিবাড়ি’ সংরক্ষণে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এলাকাবাসী।
সাননিউজ/আরপি