পার্বত্য চট্টগ্রামের উঁচু–নিচু পাহাড়ে বা সাধারণত জমির আশেপাশে সবজি ক্ষেতে পরগাছা হিসেবে জন্মায় বর্ষজীবী গুল্ম একটি অনাবাদি উদ্ভিদ। যার বৈজ্ঞানিক নাম Amaranthus Spinosus বা ইংরেজিতে Spiny Amaranth আর বাংলায় বলা হয় কাঁটানটে।
কাঁটানটে বহুবর্ষজীবী একটি গুল্মজাতীয় কাঁটাযুক্ত পাতাবিশিষ্ট আগাছা। বর্ষা শেষে গাছে ফুল হয় এবং আশ্বিনে বীজ পরিপক্ব হয়ে ঝরে পড়ে। সেই বীজ থেকেই বংশবিস্তার হয়ে থাকে।
খাল, বিল, পতিত জমি, সবজি ক্ষেত ও ক্ষেতের আইলে নিজে থেকেই জন্মায় বর্ষজীবী কাঁটানটে। এটি দেখতে শাকের মতো। তবে এর কাণ্ডে কাঁটা থাকে। সাধারণত ১.০–১.২ মিটার (৪০–৪৮ ইঞ্চি) পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পাতার আকৃতি ছোট। পাতার বোঁটায় দৃঢ় লম্বা সূচালো কাঁটা থাকে। কাণ্ড খাড়া এবং শাখা–প্রশাখাবিশিষ্ট। ফুলের রং ফিকে সবুজ, গুচ্ছবদ্ধ অবস্থায় থাকে।
কাঁটানটে গাছের বীজের রং কালো হলেও উজ্জ্বল হয়ে থাকে। একে কাটিংয়ের মাধ্যমেও বংশবিস্তার ঘটানো যায়। এমনকি শাক–সবজির ক্ষেতেও দু–চারটি কাঁটানটে দেখতে পাওয়া যায়।
কাঁটানটে সাধারণত দেশের সর্বত্র কম–বেশি দেখা যায়। তবে ৮–৯ প্রজাতির নটে রয়েছে। এর মধ্যে নটে শাক—সাদানটে, চাঁপানটে, লালনটে, বননটে, সবুজনটে উল্লেখযোগ্য। তবে পার্বত্য এলাকায় দুটি প্রজাতির নটে বেশি পাওয়া যায়—সবুজ ও রাঙা লাল নটে। অঞ্চলভেদে একেক এলাকায় এরা ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন কাঁটাখুইড়া, খুড়াকাঁটা, খৈরাকাঁটা, কাঁটা মাইরা; চট্টগ্রামের ভাষায় কাঁটামারিশ, কুমিল্লার ভাষায় কাঁটা মাইল্লা ইত্যাদি।
স্থানীয় কৃষক রিমন হোসেন বলেন, “সারা বছর কিছু না কিছু সবজি করি, তবে জমিতে প্রচুর কাঁটা মাইরা গাছ জন্মে। বীজ না ফেলেও এমনভাবে জন্মানো গাছ আর দেখিনি। তবে শাক হিসেবে এটি আমাদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। খেতেও খুব সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।”
কাঁটানটে শাক পুষ্টিগুণে ভরপুর। খাবার উপযোগী কাঁটানটে শাকে রয়েছে—ভিটামিন এ, ভিটামিন বি৬, ভিটামিন সি, ভিটামিন কে, থায়ামিন, রাইবোফ্লাভিন, নিয়াসিন, প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড ও প্রোটিন। খনিজ উপাদানের মধ্যে রয়েছে ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, জিঙ্ক, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, সেলেনিয়ামসহ বহু ঔষধিগুণ। তবে সবুজ নটে শাকের চেয়ে রাঙা বা লাল নটে স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান বেশি রয়েছে।
বাজারে শাক বিক্রি করতে আসা শেফালীকা ত্রিপুরা বলেন, “জমিতে এ শাক প্রচুর পাওয়া যায়। সবসময় আনা হয় না। মাঝে মাঝে দু–চার মুঠো শাক বিক্রির জন্য নিয়ে আসি। আনার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রি হয়ে যায়। প্রতি মুঠো শাক ২০ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি করি। বাজারে কাঁটা মাইরা শাকের চাহিদা অনেক।”
খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন হাটবাজার ঘুরে দেখা গেছে, বিশেষ করে বিকালবেলায় পাহাড়ি হাট বসে। দূরদূরান্ত থেকে আনা বিভিন্ন ধরনের শাকের পাশাপাশি কাঁটানটে বা কাঁটা মাইরার দেখা মেলে। অন্যান্য শাকের মতো এ কাঁটানটে শাক খাওয়ায় অনেকে অভ্যস্ত না থাকায় এর গুণাগুণ ও উপকারীতা সম্পর্কে অনেকে অজ্ঞাত। অথচ এ শাক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে শরীরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
গ্রামীণ জনপদের প্রান্তিক মানুষের অপুষ্টি দূরীকরণে যুগ যুগ ধরেই ভূমিকা রাখছে বাহারি অচাষকৃত উদ্ভিদবৈচিত্র্য। আমাদের বাড়ির আশপাশেই রয়েছে এসব উদ্ভিদ বৈচিত্র্য। যে উদ্ভিদগুলো মানুষের নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টির আধার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। নিরাপদ খাদ্যের জন্য এসব উদ্ভিদ বৈচিত্র্য সংরক্ষণ যেমন জরুরি, তেমনি এদের ব্যবহারও বাড়ানো প্রয়োজন।
মাটিরাঙা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ সবুজ আলী বলেন, “কাঁটানটে অন্যান্য শাকের চেয়ে কম নয়। এটি ঔষধিগুণসম্পন্ন ভেষজ উদ্ভিদ, যা বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় এবং স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।”
খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নাসির উদ্দীন চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশের সর্বত্র কাঁটানটে দেখা মেলে। যদিও এটি চাষযোগ্য শাক নয়। অনাবাদি জমি বা রাস্তার আশপাশের পরিত্যক্ত জায়গায় এ গাছ জন্মায়। তবে এতে প্রচুর পরিমাণে স্বাস্থ্যকর উপাদান রয়েছে।”
সাননিউজ/আরপি