রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শুক্রবার সকালে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় আতঙ্কে সবাই। এর উৎপত্তিস্থল দেশে হওয়ায় এতে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন ভূমি বিশেষজ্ঞসহ আবহাওয়া অধিদফতর। শুক্রবার (২১ নভেম্বর) স্থানীয় সময় সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটের দিকে ২৬ সেকেন্ডের এ ভূমিকম্পটির উৎপত্তি হয়েছে নরসিংদীর মাধবদীতে। বিশেষজ্ঞদের মতে ভূমিকম্পটি হতে পারে বড় কোনো ভূমিকম্প ঘটার আগাম সতর্কবার্তা।
শুক্রবারের কম্পনটিকে Foreshock বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ভূমিকম্প সাধারণত তিন ধাপে ঘটে: Foreshock, Mainshock ও Aftershock।
আগামী কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিনের মধ্যে বড় ধরনের কম্পনের আশঙ্কা করে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন ভূতত্ত্ববিদরা।
গবেষকরা বলছেন, কোনো স্থান বা দেশে দীর্ঘসময় ধরে ভূমিকম্প না হলে সেখানে শক্তি জমা হতে শুরু হয়। এর কারণে শত বছরের ব্যবধানে ঘটে শক্তিশালী ভূমিকম্পের ঘটনা। বাংলাদেশে প্লেট অঞ্চলে গত ১০০ বছরে কোনো বড় ম্যাগনিচিউড রিলিজ হয়নি। তাই দেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের শঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ মেহেদী আহমেদ আনসারী জানান, দেশে বড় ভূমিকম্পের দীর্ঘ ইতিহাস থাকলেও প্রায় একশ বছর ধরে দেশে বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি। ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এক থেকে তিন লাখ মানুষ হতাহত এবং শহরের প্রায় ৩৫ শতাংশ ভবন ধসে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সরকারের উদ্যোগ নেয়া জরুরী।
গবেষণা অনুযায়ী, ৭ মাত্রার ভূমিকম্প ১০০–১২৫ বছর পরপর এবং ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ২৫০–৩০০ বছর পরপর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ হিসেবে ১৯৩০ সালের পর বড় ধাক্কা না আসায় ঝুঁকি বাড়ছে।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ মেহেদী আহমেদ আরও বলেন, অতীতে ১৮৬৯ সালের কাছাড় ভূমিকম্প (৭.৬), ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ভূমিকম্প (৭.১), ১৮৯৭ সালের ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান’ ভূমিকম্প (৮.১) এবং ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প (৭.৬)—এসব বড় দুর্যোগ এ অঞ্চলে ঘটেছে।
শুক্তিশালী ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ মেহেদী আহমেদ আনসারীর পরামর্শ-
১। ভবনগুলোকে সবুজ, হলুদ ও লাল—এই তিন শ্রেণিতে চিহ্নিত করতে হবে। এখানে সবুজ মানে ঝুঁকিমুক্ত, হলুদ মানে সংস্কার প্রয়োজন এবং লাল ভবন মানে অবিলম্বে খালি করে মজবুত করা জরুরি।
২। হলুদ ও লাল রংয়ের ভবনগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য বিল্ডিং রেট্রোফিটিং করা। আমেরিকা, জাপান, ভারত, তুরস্ক, চিলিতে মানুষের জীবন বাঁচাতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
৩। নতুন ভবন তৈরির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নীতিমালা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন।
৪।ঢাকায় জরুরি ভিত্তিতে ভবনের কাঠামোগত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। ঝুঁকিযুক্ত এরিয়ার মানচিত্র তৈরি সমাধানের উপায় বের করা।
৫। জরুরি পরিস্থিতিতে রেসকিউ রুট নিশ্চিত করা। এরজন্য নির্দিষ্ট রাস্তাগুলো চিহ্নিত করে তা সবসময় খোলা রাখা যাতে অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস ঢুকতে পারে।
৬। স্কুল, অফিস, বাসা-বাড়ি সব জায়গায় বছরে অন্তত ২ বার ভূমিকম্প মহড়া করা ও সবার মধ্যে জনসচেতনতা তৈরি করা।
আবহাওয়া অধিদফতরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবাইয়াত কবির বড় ভূমিকম্পের আগাম বার্তা দিয়ে বলেছেন, ঢাকা এবং এর আশপাশে বিগত কয়েক দশকে সংঘটিত হওয়া ভূমিকম্পের মধ্যে এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সর্বোচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প। ঐতিহাসিকভাবে এ অঞ্চলে একাধিক বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। যা প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। যেকোনো সময় বাংলাদেশে আরও বড় ভূমিকম্প হতে পারে। ঠিক কবে হবে সেটা আমরা বলতে পারছি না। ডিজিটাল পর্যবেক্ষণ শুরুর পর ঢাকার কাছে ৫.৭ মাত্রার এটাই সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প। বড় ভূমিকম্পের পর আফটারশক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যদিও এখন পর্যন্ত তেমন কিছু হয়নি।
তিনিও, ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে মানার ওপর জোর দেন।
শুক্রবারের ভূমিকম্পে উৎপত্তিস্থল নরসিংদীতে বাবা-ছেলেসহ পাঁচজন, ঢাকায় চার ও নারায়ণগঞ্জে এক শিশুসহ তিন জেলায় মোট ১০ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে।এতে আহত হয়েছেন কয়েক শত মানুষ।
এদিকে, আজ শনিবার (২২ নভেম্বর) সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটের দিকে গাজীপুর ও সাভারের মাঝামাঝি আশুলিয়ার বাইপাইলে রিখটার স্কেলে ৩.৩ মাত্রার ১২ সেকেন্ড ভূমিকম্প অনুভূত হয়। যা রেকর্ড করে আবহাওয়া অধিদফতরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র।
সাননিউজ/আরপি