এস.এম হাসানুজ্জামান: বাংলাদেশের রাজনীতি আবারও এক জটিল মোড়ে দাঁড়িয়েছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে যে অনিশ্চয়তা ও মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে, তা কেবল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অচলাবস্থা নয় বরং রাষ্ট্রীয় দিকনির্দেশনার ওপরও গভীর প্রশ্ন তুলেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ রাজনৈতিক দলগুলোকে সাত দিনের সময় দিয়েছে এই সময়ের মধ্যে আলোচনায় বসে একটি ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে হবে। নইলে সরকার নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে। শুনতে যেমন দৃঢ় মনে হয়, বাস্তবে এটি এক গভীর রাজনৈতিক জটিলতার প্রতিফলন। কারণ সাত দিনের মধ্যে কোনো চমক ঘটানো সম্ভব নয় যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা অনুপস্থিত থাকে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনাস্থা, অবিশ্বাস এবং প্রতিদ্ব সংস্কৃতি বছরের পর বছর ধরে প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে গেছে। সেই পরিবেশে ঐক্যমত্য খুঁজে পাওয়া নিছক স্বপ্নের মতো। রাষ্ট্র এখন যেখানে দাঁড়িয়েছে, সেখানে সংলাপ ও ঐক্য ছাড়া বিকল্প নেই।
জুলাই সনদ মূলত সংবিধান সংস্কার, ক্ষমতার ভারসাম্য এবং রাজনৈতিক কাঠামোর সংস্কার নিয়ে। এটি একটি অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। জনগণ ভেবেছিল, সব দল একত্রিত হয়ে একটি নতুন সামাজিক চুক্তি গড়ে তুলবে, যেখানে গণতন্ত্র শুধু ভোটে সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং নীতি, মূল্যবোধ এবং প্রশাসনিক জবাবদিহিতাতেও প্রতিফলিত হবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সেই আশার প্রদীপ ক্রমেই নিভে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অবস্থান থেকে এক চুলও সরছে না। প্রত্যেকেই অন্যপক্ষকে দায়ী মনে করছে। অথচ গণতন্ত্রে দায় সবসময়ই যৌথ; কেউ এককভাবে মুক্ত নয়।
অন্তর্বর্তী সরকার একদিকে রাজনৈতিক মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে। তারা কোনো দলের প্রতিনিধি নয় বরং অন্তর্বর্তী সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার প্রতীক। কিন্তু সরকারেরও সীমাবদ্ধতা আছে। তারা চাইলে দলগুলোকে টেবিলে বসাতে পারে না। যদি দলগুলো নিজেই সংলাপের জায়গা তৈরি না করে, সরকারি আহ্বান নিস্ফল হবে। “দলগুলো সাত দিনের মধ্যে ঐক্যমত্যে পৌঁছাবে” শোনাতে দৃঢ় মনে হলেও, বাস্তবে এটি সময় কেনার মতো। সরকার আশা করতে পারে রাজনৈতিক চাপের মুখে দলগুলো নিজেদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করবে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় রাজনৈতিক অবস্থান আলোচনা দিয়ে নয় বরং পরিস্থিতির চাপ, আন্দোলন বা আন্তর্জাতিক চাপের কারণে বদলায়।
এখন সবচেয়ে বড় দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর। এই অনিশ্চয়তার জন্ম তাদের অনড় অবস্থান থেকেই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধিতা মানে বিকল্প ধারণা প্রদান; কিন্তু বাংলাদেশে বিরোধিতা মানে প্রতিপক্ষকে অস্বীকার করা এবং তাকে রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে চিত্রিত করা। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রশ্নেও সেই প্রবণতা দেখা দিয়েছে। বিএনপি, জামায়াত ও কিছু ইসলামপন্থী দল বলছে নির্বাচনের আগে কোনো গণভোট বা সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া যাবে না। তারা মনে করছে, এটি নির্বাচনী প্রস্তুতিকে জটিল করবে। অন্যদিকে সংস্কারমুখী দলগুলো বলছে জুলাই সনদ জাতীয় ঐকমত্যের নথি, এটি বাস্তবায়ন না করলে নির্বাচন অর্থহীন হবে। এই দ্বিমুখী অবস্থান রাষ্ট্রকে অনিশ্চিত অবস্থায় দাঁড় করিয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যুক্ত ঐকমত্য কমিশন সুপারিশ দিয়েছে যা রাজনৈতিকভাবে প্রশংসনীয়। কমিশন প্রস্তাব করেছে, বিশেষ আদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন এবং গণভোট আয়োজন করা হোক। অনুমোদন পেলে নতুন সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করবে। কিন্তু আইনি বিতর্কও দেখা দিয়েছে। সংবিধানে গণভোটের বিধান থাকলেও তা সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে সরাসরি প্রযোজ্য নয়। বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন, এমন পদক্ষেপের সাংবিধানিক বৈধতা কতটা দৃঢ় হবে। তবুও রাজনৈতিক জট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আইনি সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে হাত গুটিয়ে বসা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের সংকট কখনো কেবল আইনের ফ্রেমে সমাধান হয়নি বরং রাজনৈতিক সমঝোতা ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে হয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো জুলাই সনদের মাধ্যমে আমরা আসলে কী চাইছি? নতুন সামাজিক চুক্তি নাকি ক্ষমতার ভারসাম্য পুনর্বিন্যাস? বিশ্লেষকরা বলছেন, সনদ রাজনৈতিক সংস্কার ও স্বচ্ছতার সুযোগ এনে দিতে পারত, যদি এটি দলীয় প্রতিযোগিতার বিষয় না হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সনদ এখন এক দলীয় প্রতীকে পরিণত হয়েছে। কেউ একে আশার প্রতীক মনে করছে, কেউ ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার। ফলে জাতীয় প্রয়াস কেবল পার্টি পলিটিক্সের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। জনগণ ক্লান্ত। তাদের চোখে রাজনীতি মানে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, কাদা ছোড়া, অচলাবস্থা। তারা আশা করেছিল, জুলাই সনদ রাজনীতিকে নতুন ধারায় প্রবাহিত করবে। এখন তাদের মনে একটাই প্রশ্ন এই সনদ যদি বিভাজন সৃষ্টি করে, তাহলে এর প্রয়োজন কী? জনগণ ভোট, স্থিতি, নীতি চায়। তারা চায় না দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় দেশকে অনিশ্চয়তার মুখে ফেলা হোক। অর্থনীতি রাজনীতির ছায়ায় ক্লান্ত। বিনিয়োগ থেমে আছে, বাজারে অনিশ্চয়তা, চাকরির বাজারে স্থবিরতা। রাজনৈতিক স্থিতি ছাড়া অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার অসম্ভব। দলগুলো যদি আরও বিতর্কে লিপ্ত থাকে, তার সরাসরি প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষা করছে রাজনৈতিক স্থিতি ফিরে আসে কিনা। কিন্তু তারা দেখছে, দলগুলো নিজেদের অবস্থান নিয়ে ব্যস্ত, জনগণের আস্থা পুনর্গঠনে নয়। অন্তর্বর্তী সরকারও চাপের মুখে। তারা শুধু নির্বাচনের প্রস্তুতি নয়, রাজনৈতিক সংকট ব্যবস্থাপনার কাজও করছে। কিন্তু এটি একক সরকারের দায়িত্ব নয়। যদি রাজনীতি সংলাপবিমুখ হয়, প্রশাসনিক উদ্যোগ ব্যর্থ হবে। সাত দিনের সময় সীমা রাজনৈতিক বার্তা “সমঝোতা না হলে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।” তবে একতরফা সিদ্ধান্তও নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করবে।
এখন প্রয়োজন যৌথ উদ্যোগ সরকার শুধু মধ্যস্থতাকারী নয়, ঐক্যের কাঠামো তৈরি করবে। গণভোটও অনিশ্চিত। এটি গণতন্ত্রের মহৎ উপায়, কিন্তু ভুল ব্যবহারে বিভ্রান্তি ও বিপর্যয় ডেকে আনে। জনগণ যদি প্রকৃত তথ্য না পায়, যদি গণভোট রাজনৈতিক প্রচারণার শিকার হয়, তাহলে এটি হবে আরেকটি বিভাজনের উৎস। সচেতন জনগণ, অংশগ্রহণ রাজি দল, নিরপেক্ষ প্রশাসন এই তিন শর্ত না থাকলে ফল ইতিবাচক হবে না।বাংলাদেশের ইতিহাস বলে, সংকটের সময়ে নেতৃত্ব ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। যারা নেতৃত্বে আছেন, তারা যদি মনে করেন জনগণকে অন্ধকারে রেখে দলীয় স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে, তারা ভুল করছেন। সময় বদলেছে, প্রযুক্তি বদলেছে, জনগণ সচেতন। তারা প্রশ্ন করে, যুক্তি খোঁজে, সমালোচনা করে। রাজনীতি যদি জবাবদিহিতে সক্ষম না হয়, গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঢেকে যাবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যেমন রাজনৈতিক ঐক্য প্রয়োজন, তেমনি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতিও দরকার। সংলাপভিত্তিক, সহনশীল, দায়িত্বশীল সংস্কৃতি। ক্ষমতা নয়, দায়িত্ব মুখ্য। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য মানে দলীয় স্বার্থ বিসর্জন নয়; বরং জনগণের স্বার্থে নিজেকে সীমিত করা। নেতারা রাষ্ট্রকে ক্ষমতার কেন্দ্রে দেখেন, নাগরিককে নয়। জুলাই সনদ ঠিক এই চিন্তাধারাকে বদলাতে পারত যদি দলীয় সমীকরণের বাইরে বাস্তবায়ন হতো। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ নতুন সামাজিক চুক্তির সন্ধিক্ষণে। এই চুক্তি হতে হবে জনগণ, সরকার ও দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের। জুলাই সনদ সেই বিশ্বাস পুনর্গঠনের সুযোগ ছিল। যদি হাতছাড়া হয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একে হারানো সম্ভাবনা মনে রাখবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত দলগুলোকে আলোচনায় ফিরিয়ে আনা, নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী সংগঠন, শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষকদের অন্তর্ভুক্ত করে বিস্তৃত জাতীয় সংলাপ আয়োজন। রাজনৈতিক সমাধান শুধু রাজনীতিবিদদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হলে তা দোদুল্যমান হবে। জনগণের অংশগ্রহণই প্রক্রিয়াকে বৈধতা দেয়। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি স্পষ্ট জুলাই সনদ বাস্তবায়ন কেবল রাজনৈতিক দায়িত্ব নয়, নৈতিক পরীক্ষা। ব্যর্থতা মানে শুধু রাজনৈতিক পরাজয় নয়; এটি গণতান্ত্রিক যাত্রার ব্যর্থতা। সাত দিনের সময় সীমিত, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে দিগন্ত নির্ধারণী মুহূর্ত। যদি দলগুলো সংলাপের দরজা খোলে, তা হবে সাফল্য। রাজনৈতিক সমঝোতা একদিনে হয় না; এটি ধীরে ধীরে বিশ্বাসের দেয়াল গড়ে তোলে।
আজকের মানুষ নির্বাচন, স্থিতি, শান্তি চায়।তারা চায় রাজনীতি দায়িত্বশীল, প্রতিশ্রুতিশীল, উন্নয়নমুখী। জুলাই সনদ সেই প্রত্যাশার প্রতীক হতে পারত, যদি সবাই তা নিজেদের অর্জন মনে করত, কারও দখলদারিত্ব নয়। এখনো সময় আছে। দলগুলো যদি অতীত ভুল থেকে শিক্ষা নেয়, ক্ষমতার চেয়ে রাষ্ট্রের স্থিতিকে বড় বোঝে, সনদ হতে পারে নতুন আশার আলো। ব্যর্থ হলে, এটি প্রমাণ হবে বাংলাদেশের রাজনীতি এখনো বড়ভাবে ভাবতে শেখেনি। জুলাই সনদ ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, কিন্তু আশাহীন নয়। যতদিন জনগণ গণতন্ত্রে আস্থা রাখে, আলো জ্বলে। দায়িত্ব এখন সরকারের, রাজনৈতিক দলগুলোর এবং সর্বোপরি সবার এই আলো নিভে যেতে দেওয়া যাবে না।
এসএম হাসানুজ্জামান অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কলাম লেখক, রংপুর সদর রংপুর।
সান নিউজ/আরএ