রাজনীতিতে বা বিচারব্যবস্থায় যখন কোনো রায় বা প্রক্রিয়া নিয়ে ন্যায়বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তখনই আলোচনায় আসে ‘ক্যাঙারু কোর্ট’ শব্দটি। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে ঘিরে শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেনের এক মন্তব্যের পর এই শব্দগুচ্ছ আবারও আলোচনায় এসেছে।
২৮ অক্টোবর রোববার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেনকে দেখা যায় এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে হাসতে। সাংবাদিকরা তাঁকে প্রশ্ন করেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে কেউ কেউ ‘ক্যাঙারু কোর্ট’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন, এ বিষয়ে তাঁর মতামত কী। জবাবে তিনি বলেন, “যারা ক্যাঙারু কোর্ট মনে করে সেটা তাদের ব্যাপার। আমি মনে করি না কোনো অস্বচ্ছতার কিছু আছে। আদালতে কেউ আমাকে কখনও কোনো চাপ দেয়নি।”
প্রশ্ন ওঠে- আদালতের সঙ্গে একটি প্রাণীর নাম কেন যুক্ত হলো?
‘ক্যাঙারু কোর্ট’ শব্দগুচ্ছ এসেছে অস্ট্রেলিয়ার প্রাণী ক্যাঙারুর নাম থেকে। ক্যাঙারু যেমন এক লাফে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যায়, তেমনি তাড়াহুড়া করে বিচার সম্পন্ন করা আদালতকেও রূপকভাবে বলা হয় ‘ক্যাঙারু কোর্ট’। হার্ভার্ড ল রিভিউ ও ব্ল্যাক’স ল ডিকশনারির সংজ্ঞায়, এটি এমন এক স্বঘোষিত বা প্রহসনমূলক আদালত, যেখানে ন্যায়বিচারের নীতি উপেক্ষা করা হয়, কিংবা রায় আগেই নির্ধারিত থাকে।
আইনজীবীদের মতে, ক্যাঙারু কোর্ট মূলত এমন বিচার প্রক্রিয়া, যেখানে ন্যায্য শুনানির সুযোগ নেই, প্রতিরক্ষার অধিকার খর্ব করা হয়, অথবা বিচার কার্যত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়।
শব্দটির উৎপত্তি উনিশ শতকে যুক্তরাষ্ট্রে। সে সময় সীমান্ত অঞ্চলের ঘুরে বেড়ানো বিচারকেরা দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি করতেন, অনেক সময় যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে। তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ‘লাফিয়ে’ বিচার করতেন, এই আচরণ থেকেই “ক্যাঙারু কোর্ট” শব্দের জন্ম
শুধু বাংলাদেশ নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও ‘ক্যাঙারু কোর্ট’ শব্দটি বহুল আলোচিত। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল ভবনে হামলার ঘটনায় তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হলে কংগ্রেসের তদন্ত কমিটিকে “ক্যাঙারু কোর্ট” বলে সমালোচনা করেন। একইভাবে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও পার্লামেন্টারি তদন্ত প্রক্রিয়াকে একসময় এই শব্দে উল্লেখ করেছিলেন। ভারতে গণমাধ্যমের পক্ষপাতমূলক আচরণের সমালোচনাতেও এ শব্দ ব্যবহার করেছেন দেশটির তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণ।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও ‘ক্যাঙারু কোর্ট’ শব্দটি রাজনৈতিক ভাষ্যে ফিরে এসেছে। ২০২৩ সালে নুরুল হক নুর গণঅধিকার পরিষদের নিবন্ধন না পাওয়ার পর মন্তব্য করেন, “আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রিত ক্যাঙারু কোর্টে ন্যায়বিচার পাওয়া যায় না।” সম্প্রতি মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও ‘ক্যাঙারু কোর্ট’ শব্দ ব্যবহার করা হয় বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে উল্লেখ আছে।
বিচারিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বারবার ফিরে আসা এই শব্দগুচ্ছ এখন হয়ে উঠেছে ন্যায়বিচারের প্রশ্নে এক প্রতীকী প্রতিবাদ। অনেকের মতে, ‘ক্যাঙারু কোর্ট’ শুধু একটি শব্দ নয়, এটি ন্যায়, স্বচ্ছতা ও বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের আস্থার সূচকও বটে।