এক সময় এই পেশা ছিল সমাজের বিবেক। সত্যের কণ্ঠস্বর, ন্যায়ের হাতিয়ার। সাংবাদিকতা মানেই ছিল দায়বদ্ধতা, সততা আর সাহস। আজ নিউজরুম এর ভেতরে ঢুকলে দেখা যায়, সেই নীতির চা ঠান্ডা হয়ে আছে। টেবিলের কোণে রাখা কাপটা যেন প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে সাংবাদিকতার ভেতরের শীতলতার।
পেশার প্রতি দায়বোধ কমে যাচ্ছে , এখন অনেক তরুণ সাংবাদিক কয়েক মাস কাজ শিখেই অন্য হাউজে চলে যাচ্ছেন, ভালো অফার, বড় ব্র্যান্ড, কিংবা একটু বেশি টাকা। এটা স্বাভাবিক ক্যারিয়ার উন্নতি বলা যেতে পারে, কিন্তু সমস্যা তখনই, যখন সেই বিদায়ের পথে থেকে যায় অপেশাদারিত্ব ও দায়িত্বহীনতা।
কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সময় যে বিশ্বাস, সময় ও অর্থনৈতিক ইনভেস্টমেন্ট প্রতিষ্ঠানটি করে, তা যেন কারও কাছে আর দায়বদ্ধতার বিষয় নয়। আজকাল “জব” আছে, “প্রফেশন” আছে, কিন্তু “প্যাশন” হারিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানের নীরব ক্ষত, একজন সাংবাদিক যখন হাউজ ছেড়ে চলে যান, তখন শুধু একটা চেয়ার ফাঁকা হয় না, নষ্ট হয় একটি টিমের কাঠামো, ভেঙে পড়ে ধারাবাহিকতা। নতুন করে কাউকে ট্রেইনিং দিতে হয়, নেটওয়ার্ক গড়তে হয়, অথচ সেই ক্ষতির মূল্য কেউ বোঝে না।
অনেকে আবার কাজ করতে করতেই, ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজ ফেলে রাখেন বা অন্য হাউজে পার্ট-টাইম কাজ করেন, এমনও আছেন যারা হাউজের ইনভেস্টমেন্টে হাউজের কাজ না করে নিজস্ব অনলাইন মিডিয়া দাঁড় করাতে কাজ করেন। এতে শুধু প্রজেক্টই নয়, প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর যে মিডিয়া জনগণের বিশ্বাসে টিকে থাকে, তার ভেতরের এই বিশ্বাসঘাতকতা পুরো পেশাটাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
নীতি এখন ‘ব্রেকিং নিউজ’-এর নিচে চাপা, গণমাধ্যম একসময় ছিল “মানুষের কণ্ঠস্বর”, এখন অনেক ক্ষেত্রে তা “ক্লিকের কণ্ঠস্বর” হয়ে যাচ্ছে। স্পিড, ভিউ, শেয়ার এগুলোর দৌড়ে সত্যতা ও মানবিকতা পিছিয়ে পড়ছে। নিউজরুম এ আর নীতি নিয়ে আলোচনা হয় না, হয় ট্রেন্ড নিয়ে, হয় রিচ নিয়ে।
ফলাফল, সাংবাদিকতা এখন শুধু পেশা নয়, অনেকের কাছে এটি একটি সিঁড়ি। আর সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে কেউ ভাবছে না নিচে পড়ে থাকা নীতির কাপের চা কবে গরম হবে।
সাংবাদিকতা মানে শুধু রিপোর্ট লেখা নয়, সাংবাদিকতা মানে হলো দায়িত্ববোধ, যে সংবাদ জনগণের সামনে যাবে, তার সামাজিক প্রভাব কী হতে পারে, তা বোঝা।
একজন সংবাদকর্মী শুধু প্রতিষ্ঠানের নয়, পাঠকেরও কাছে দায়বদ্ধ। তার চলে যাওয়া মানে একটি আস্থার ভাঙন। তাই প্রতিষ্ঠান যেমন কর্মীর শ্রমের মূল্য দিতে হবে, তেমনি সাংবাদিককেও ভাবতে হবে- তার সততা, সময় ও নীতি কারও ইনভেস্টমেন্টের অংশ।
প্রয়োজন নীতি পুনর্জাগরণের - আমরা হয়তো এখনো সময়ের সন্ধিক্ষণে আছি। পেশাটিকে বাঁচাতে হলে প্রথমেই ফিরিয়ে আনতে হবে নৈতিকতার উষ্ণতা। নিউজরুম এর টেবিলে নীতির চা আবার গরম করতে হবে- সততা, দায়বোধ আর পেশাদারিত্বের আগুনে।
কারণ দিনের শেষে সাংবাদিকতা শুধু একটা পেশা নয়, এটা মানুষের প্রতি দায়, সময়ের প্রতি প্রতিশ্রুতি, এবং সমাজের প্রতি নৈতিক দায়িত্ব। যখন আমরা সেই দায় ভুলে যাই, তখন সত্যিই মনে হয়, সাংবাদিকতার টেবিলে নীতির চা ঠান্ডা হয়ে গেছে।