বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প আবারও আগুনে কাঁপছে। কখনো চট্টগ্রামে, কখনো ঢাকায়, আর সর্বশেষ রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে- প্রতিবার একই দৃশ্য, একই ধ্বংস।
রপ্তানিমুখী এই খাত যখন আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখন ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ড নতুন করে প্রশ্ন তুলছে- এগুলো কি নিছক দুর্ঘটনা, নাকি কোনো অদৃশ্য ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত?
শুধু চলতি মাসেই একাধিক বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে পোশাক কারখানা ও সংশ্লিষ্ট স্থাপনাগুলোতে। আগুনে পুড়েছে কোটি টাকার মালামাল, ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন শতাধিক শ্রমিক। কেউ হারিয়েছেন জীবিকা, কেউ জীবনের সঞ্চয়।
আগুনের পরের দৃশ্য একটাই- জ্বলন্ত মেশিন, পোড়া কাপড়ের স্তূপ আর শ্রমিকদের অসহায় মুখ।
সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে। যেখানে অগ্নিকাণ্ডে রপ্তানির জন্য প্রস্তুত পোশাক, দামী কাঁচামাল ও গুরুত্বপূর্ণ স্যাম্পল পুড়ে গেছে।
বিজিএমইএ’র হিসাব অনুযায়ী, ক্ষতির পরিমাণ শত কোটি টাকার বেশি হতে পারে। কার্গো ভিলেজটি দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, প্রতিদিন এখান থেকে ২০০–২৫০টি কারখানার পণ্য বিদেশে পাঠানো হয়।
বিজিএমইএ’র সিনিয়র সহ-সভাপতি ইনামুল হক খান বলেন,
“এই আগুন শুধু কিছু পণ্য পুড়িয়েছে তা নয়, এটি দেশের রপ্তানি আস্থার ওপর আঘাত হেনেছে। বিমানবন্দরের মতো জায়গায় এমন দুর্ঘটনা কেবল ‘অসতর্কতা’ হতে পারে না।”
ফায়ার সার্ভিস বলছে, অধিকাংশ আগুনই বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে। তবে শ্রমিক সংগঠন ও বিশ্লেষকদের একটি অংশ এই ব্যাখ্যায় পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয়। তাদের মতে, এমন বারবার ও একই ধরনের অগ্নিকাণ্ডকে কেবল ‘দুর্ঘটনা’ বলে দায় মেটানো যায় না।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“যেভাবে একই ধরনের আগুন ধারাবাহিকভাবে ঘটছে, তাতে মনে হয় কেউ হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে শিল্পের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে চাইছে।”
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অগ্নিকাণ্ডগুলো দেশের রপ্তানি প্রবাহে ‘মনস্তাত্ত্বিক ধাক্কা’ তৈরি করছে। বিদেশি ক্রেতারা নতুন করে উদ্বিগ্ন হচ্ছেন কারখানার নিরাপত্তা ও উৎপাদন ধারাবাহিকতা নিয়ে। কেউ কেউ ইতিমধ্যেই বিকল্প উৎস হিসেবে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার দিকে ঝুঁকছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান বলেন,
“প্রতিটি আগুনই বাংলাদেশকে এক ধাপ পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। বিদেশি ক্রেতারা ভাবছেন, নিরাপত্তাহীন একটা দেশে কি তারা বিনিয়োগ বাড়াবেন?”
অন্যদিকে শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি, অগ্নিকাণ্ডের পর বেশিরভাগ মালিকই দায় এড়ানোর চেষ্টা করেন। ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা মাসের পর মাস বেকার থাকেন, কিন্তু তাদের পাশে দাঁড়ায় না কেউ।
এক পোশাক শ্রমিকের ভাষায়,
“প্রতিবারই আগুন লাগে, কিন্তু আগুনের কারণটা কেউ জানতে চায় না। আমাদের জীবন যেন কারও কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।”
সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর অবশ্য বলছে, প্রতিটি ঘটনারই স্বচ্ছ তদন্ত হচ্ছে এবং দায়ীদের ছাড় দেওয়া হবে না। পরিবেশ, শ্রম ও শিল্প মন্ত্রণালয় যৌথভাবে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন,
“আমরা সব দিক বিবেচনায় তদন্ত করছি- দুর্ঘটনা, নাশকতা, বা প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা। কোনো কিছুই আমরা বাদ দিচ্ছি না।”
তবে বাস্তবতা হলো, তদন্তের ফল সাধারণ মানুষের কাছে খুব কমই পৌঁছায়। কয়েক মাস পর বিষয়টি হারিয়ে যায় নতুন কোনো খবরে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ‘অদৃশ্য আগুন’ শুধু গার্মেন্টস নয়- বাংলাদেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্যও বড় হুমকি হয়ে উঠছে। কারণ, গার্মেন্টস খাতের ওপরই নির্ভর করে দেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি, এবং এখানে কর্মরত প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ।
তবুও প্রশ্ন থেকেই যায়—
এত উন্নয়ন, এত প্রযুক্তি, তবুও কেন বারবার আগুন?
এটা কি সত্যিই দুর্ঘটনা, নাকি অর্থনীতির বিরুদ্ধে কোনো অদৃশ্য বার্তা?
যতদিন না এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত প্রতিটি ধোঁয়া ওঠা ভবন শুধু আগুনের নয়, বরং বাংলাদেশের রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির গভীর সংকেতের প্রতীক হয়ে থাকবে।
সাননিউজ/এও