সরকার বদলায়, কিন্তু ফাইল চালানো হাতগুলো একই থাকে। বাংলাদেশের রাজনীতির এই বাস্তব সত্যটাই যেন বোঝায়- দল পাল্টায়, মন্ত্রীরা বদলায়, কিন্তু প্রশাসনিক ক্ষমতার আসল নিয়ন্ত্রণ থাকে একই কিছু মানুষের হাতে। প্রতি নির্বাচনেই দেখা যায় নতুন স্লোগান, নতুন অঙ্গীকার, নতুন মুখ। কিন্তু সচিবালয়ের করিডোরে সেই পুরনো মুখগুলোর প্রভাব ঠিক আগের মতোই অটুট থাকে। যেন এক অদৃশ্য ছায়াশাসন, যেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দৃশ্যমান হলেও, প্রকৃত সিদ্ধান্ত হয় নেপথ্যে।
বাংলাদেশে প্রশাসনিক ক্ষমতার এই অদৃশ্য বিস্তার নতুন নয়। ইতিহাস বলছে- রাজনীতি বদলেছে, কিন্তু প্রশাসনের চরিত্র বদলায়নি। বরং রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে “দুই রঙের আমলাতন্ত্র”। কেউ ঘনিষ্ঠ বর্তমান সরকারের, কেউ অপেক্ষায় পরের দলের। ফলাফল- প্রশাসন এখন শুধু নীতির বাস্তবায়নকারী নয়, বরং নীতি নির্ধারণের গোপন অংশীদার।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রশাসনকে বলা হয় রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড। কিন্তু এখন সেই মেরুদণ্ডই হয়ে উঠেছে মস্তিষ্ক। সচিব, অতিরিক্ত সচিব কিংবা বিভাগীয় কমিশনারদের সিদ্ধান্তই আজ বাস্তবে নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রবিন্দু। নির্বাচিত সরকার অনেক সময় কেবল মুখপাত্রের ভূমিকায় সীমাবদ্ধ থাকে, আর প্রশাসনিক কাঠামো চালায় আসল খেলা।
প্রতিটি সরকারই ক্ষমতায় এসে বলে সংস্কার আনবে, প্রশাসনকে জবাবদিহিমূলক করবে। কিন্তু ছয় মাসের মধ্যেই সেই প্রতিশ্রুতি হারিয়ে যায়। পদোন্নতি হয় যোগ্যতার চেয়ে আনুগত্যে। ২০১৯ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত প্রশাসনে অর্ধেকের বেশি পদোন্নতি হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়- যা আমলাতন্ত্রকে তৈরি করেছে এক ধরনের “নির্বাচন-প্রুফ” শক্তিতে। অর্থাৎ সরকার বদলায়, কিন্তু প্রভাবশালী প্রশাসনিক চক্র অটুট থাকে।
এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রে গড়ে উঠছে এক “ডিপ স্টেট সিন্ড্রোম”- অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী এক প্রভাবমণ্ডল। সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাকাতে হয় আমলাতন্ত্রের দিকে। বাজেট অনুমোদন থেকে শুরু করে প্রকল্প বাস্তবায়ন- সব ক্ষেত্রেই নির্ধারণ হয় সচিবালয়ের সংকেত অনুযায়ী। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অনেক সময় বাধ্য হয়ে সেই নির্দেশ মানতে হয়। এভাবেই রাজনৈতিক গণতন্ত্র ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে প্রশাসনিক প্রজাতন্ত্রে।
রাজনীতিকরা জানেন- একজন সচিবের বিরোধিতা মানে পুরো প্রক্রিয়া থেমে যাওয়া। আবার আমলারা জানেন- মন্ত্রী বদলাবে, কিন্তু তারা থাকবে। ফলে তৈরি হয়েছে এক সহাবস্থানের রাজনীতি- যেখানে দুই পক্ষই ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে একে অপরের ওপর। এই অবস্থায় জনগণ ভোট দিয়ে সরকার গঠন করলেও, রাষ্ট্র চলে অদৃশ্য নির্দেশনায়।
এই বাস্তবতা গণতন্ত্রের জন্য ভয়ংকর। কারণ গণতন্ত্রের মূল শক্তি হলো জনগণের ইচ্ছা, অথচ সেই ইচ্ছা বাস্তবায়নের যন্ত্রটি এখন অনেকাংশে স্বাধীনভাবে পরিচালিত হচ্ছে। জনগণের দাবি, সংসদের সিদ্ধান্ত কিংবা মন্ত্রীর নির্দেশ- সবই কখনও আটকে যায় ফাইলের পাতায়। আর এভাবে ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের মুখোশের আড়ালে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে এক নীরব আমলাতন্ত্র।
এখনই সময় এই বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার। বাংলাদেশের প্রশাসনে প্রয়োজন নিরপেক্ষতা, জবাবদিহি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। কিন্তু তার জন্য রাজনৈতিক সাহস দরকার- যে সাহস নিজের পেছনের ঘর পরিষ্কার করতে পারে। সরকার যদি সত্যিই পরিবর্তন চায়, তবে পরিবর্তনের শুরুটা হতে হবে সচিবালয়ের ভেতর থেকে, ফাইলের টেবিল থেকে। নইলে নির্বাচনের পর মুখ বদলাবে, স্লোগান বদলাবে, কিন্তু রাষ্ট্র থাকবে একই হাতে বন্দী- অদৃশ্য, নীরব, অথচ সর্বশক্তিমান আমলাতন্ত্রের হাতে।