ক্ষমতার চেয়ারে যখন মানবিকতা নিঃশেষ হয়, তখন সেবা পরিণত হয় নিয়ন্ত্রণে। রাষ্ট্রীয় দপ্তরের ফাইলের ভারে চাপা পড়ে নাগরিকের ন্যায্য কণ্ঠস্বর, আর প্রশাসনের করিডোরে জন্ম নেয় এক নৈতিক শূন্যতা- যেখানে দায়িত্ব হারায় অর্থ, আর সেবা রূপ নেয় নিছক আনুষ্ঠানিকতায়।
সরকারি কর্মকর্তা মানেই জনগণের কর্মচারী- অন্তত সংবিধান ও সরকারি বিজ্ঞপ্তি সেটাই বলে। কিন্তু মাঠের বাস্তবতায়, জনগণের সেবার চেয়ারে বসেই অনেকে সেই জনগণকেই সেবা পেতে বাধা দেন। বিলম্ব, অবহেলা, ঘুষ এবং খারাপ ব্যবহারের সমন্বয়ে যেন একটা সুসংগঠিত "প্রাতিষ্ঠানিক দুর্ব্যবস্থা" গড়ে উঠেছে দেশের বহু সেবামূলক সরকারি প্রতিষ্ঠানে।
এই চিত্র কেবল ধারণা নয়, পরিসংখ্যানও এর সাক্ষ্য দেয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ২০২৩ সালের এক জরিপে দেখা যায়, দেশের সরকারি সেবা খাতে ঘুষ লেনদেন হয়েছে আনুমানিক ১৪ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে ঘুষপ্রবণ খাত হিসেবে উঠে আসে বিআরটিএ, ভূমি অফিস, পাসপোর্ট অফিস ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। একই সঙ্গে অভিযোগ রয়েছে, এ দফতরগুলোর সেবা পেতে হয় দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে, হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়, কখনো কখনো হেয় বা অপমানজনক ব্যবহারও সহ্য করতে হয়।
শুধু ঘুষ নয়, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সরকারি কর্মকর্তারা ‘উপস্থিত থাকলেও অনুপস্থিত’ - অর্থাৎ, দফতরে উপস্থিত থেকেও সেবা না দিয়ে অপেক্ষমাণ নাগরিককে ঘন্টার পর ঘন্টা বসিয়ে রাখেন। অনেকে আবার ছোটখাটো ফাইল ফিস, তথাকথিত 'চা-পানির টাকা' বা ‘ডিল সহজ করার ফি’ হিসেবে অপ্রত্যক্ষ ঘুষ নেন। সেবা না পাওয়া পর্যন্ত অভিযোগ করার জায়গাও অনেক ক্ষেত্রে থাকে অনুপস্থিত।
জনগণের অর্থে চলা প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন আচরণকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন এক ধরনের ‘সামাজিক ব্যাধি’ - এক নৈতিক বিকৃতি, যেখানে ক্ষমতা সেবাকে গ্রাস করে এবং নাগরিক পরিণত হয় অবহেলার শিকার। তাঁদের মতে, এটি এমন এক প্যাথলজি - যেখানে কর্তৃত্বের আসনে বসা মানুষটি নাগরিকের প্রয়োজনকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজেকে সেবার ঊর্ধ্বে ভাবতে শেখে। এর ফলে তৈরি হয় একটি ‘দ্বৈত সমাজ’ - যেখানে একপাশে সুবিধাভোগী, অন্যপাশে বঞ্চিত জনতা।
এমন প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে, কার দায় বেশি? দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তার, না কি নীরব সমাজের? অনেকেই বলছেন, আমরা নাগরিক হিসেবে এই অনিয়মকে দীর্ঘদিন সহ্য করে এসে নিজেদেরও দুর্বল করে তুলেছি। ঘুষ না দিয়ে কাজ হবে না, এ বিশ্বাস সমাজে এতটাই গেঁথে গেছে যে কেউ ঘুষ দিতে না চাইলে নিজেকেই ‘বোকা’ মনে হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঘুষ বা দুর্ব্যবহার প্রতিরোধে কেবল প্রযুক্তি নির্ভর ডিজিটালাইজেশনই যথেষ্ট নয়। দরকার প্রশাসনিক সংস্কার, কার্যকর জবাবদিহি ও সেবাগ্রহীতার দৃঢ় কণ্ঠস্বর। বিশেষ করে, প্রশাসনের মধ্যে যদি একজন কর্মকর্তা জানেন যে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে কার্যকর তদন্ত হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে - তবে তিনি দায়িত্ব পালনে আরও যত্নশীল হবেন।
সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধেও অনেক সময় জনগণ অমানবিক আচরণ করে - এমনও সত্য। কিন্তু এটি যেমন অজুহাত হতে পারে না, তেমনি সমাধানের পথও একমুখী হতে পারে না। রাষ্ট্রকে সেবা প্রদানের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হলে সমাজের উচ্চশ্রেণি, বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়ার উচিত এই ব্যাধির বিরুদ্ধে সমবেতভাবে মুখ খোলা। অন্যথায়, সেবার নামে যে যন্ত্র আমরা গড়েছি, সেটিই হয়ে উঠবে নাগরিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সবচেয়ে নির্দয় অস্ত্র।
এখন সময় এসেছে, যেখানে প্রশ্ন করতে হবে - “যাদের দায়িত্ব আমাদের সেবা দেওয়া, তারা কাকে সেবা দিচ্ছেন?”
সান নিউজ অনলাইন