একসময় উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকার তিস্তা নদী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও সেই তিস্তা নদী এখন মৃতপ্রায়।
খরস্রোতা তিস্তা নদী এখন বছরের অধিকাংশ সময় শুকিয়ে থাকে। বর্ষায় পানিতে ভাসে, আবার শীতে পরিণত হয় মরুভূমির মতো ফেটে যাওয়া বালুচরে। নদীভাঙন, বালুচর বিস্তার ও তীব্র পানিসংকটে তিস্তাপাড়ের মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম অনিশ্চয়তা ও দুর্ভোগ।
তিস্তা খাংসে হিমবাহ, যা সিকিম হিমালয়ের ৫ হাজার ৪০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। এটি সিকিম হিমালয়ের গিরিখাত ও খরস্রোতা অঞ্চল দিয়ে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে সিকিম, দার্জিলিং (পশ্চিমবঙ্গ) অতিক্রম করে অবশেষে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়।
তিস্তা নদীকে কেন্দ্র করে উত্তরবঙ্গের কৃষি, মৎস্য, সংস্কৃতি ও জীবন–জীবিকা গড়ে উঠেছিল। একসময় তিস্তা নদীর চরাঞ্চলে ধান, পাট, ভুট্টা, তিল ও সবজি চাষে ছিল সমৃদ্ধি। ১৯৮৩ সালে ভারতের গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণের পর থেকেই তিস্তার স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব আর বর্ষায় ভয়াবহ বন্যা এখন নিয়মিত দুর্যোগে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যমতে, গত এক দশকে তিস্তা নদীর ভাঙনে ২০ হাজারেরও বেশি পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। নদীর তীরঘেঁষে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার এলাকায় ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। লালমনিরহাটের মহিপুর এলাকায় তিস্তা সেতু রক্ষা বাঁধের ৩৫০ মিটার অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। কুড়িগ্রামের রাজারহাটে ৪টি গ্রামে ৭ শতাধিক পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছে। গঙ্গাচড়ায় ৫০টিরও বেশি পরিবার ঘর হারিয়েছে এবং কুড়িগ্রামের উলিপুরে শতাধিক বাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা সদর ও ফুলছড়ি উপজেলার কয়েক হাজার পরিবার বাপ–দাদার ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে।
তিস্তা বাঁচাতে গত কয়েক বছরে উত্তরাঞ্চলে একের পর এক আন্দোলন হয়েছে। ‘তিস্তা বাঁচাও, উত্তরবঙ্গ বাঁচাও’ স্লোগানে রংপুর বিভাগজুড়ে মানববন্ধন, অবস্থান কর্মসূচি ও মশাল মিছিল হয়েছে। তিস্তা নদী বাঁচানোর দাবিতে ১১৫ কিলোমিটারজুড়ে ৪৮ ঘণ্টাব্যাপী অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন এলাকার মানুষ, পরিবেশবাদী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিস্তার দুই তীরে একযোগে মশাল প্রজ্বালন করে তারা স্লোগান তোলেন—‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই।’ এ কর্মসূচিতে উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধার কয়েক হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেন।
অংশগ্রহণকারীরা বাংলাদেশ–ভারত তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি দ্রুত কার্যকর করা, তিস্তা মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা এবং প্রস্তাবিত মাস্টারপ্ল্যানে নদী পুনর্খনন, চরবাসীর পুনর্বাসন ও বাঁধ সংস্কারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি জানান।
তিস্তা নদীরক্ষা আন্দোলন কমিটি সূত্রে জানা যায়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানিয়েছেন—২০২৬ সালের জানুয়ারিতে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু হবে। ১০ বছরের মেয়াদে দুই ধাপে প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রথম ধাপে (৫ বছর) ব্যয় হবে ৯ হাজার ১৫০ কোটি টাকা—যার মধ্যে ৬ হাজার ৭০০ কোটি আসবে চীন থেকে ঋণ হিসেবে এবং ২ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয় হবে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে।
তিস্তা নদীরক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, “সরকার যদি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে নিজস্ব অর্থায়নে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু না করে, তবে তিস্তাপাড়ের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।” তিনি আরও বলেন, “সরকার ইতোমধ্যে প্রথম ধাপের জন্য ২ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।”
সাননিউজ/আরপি