ঢাকার সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) প্রতিদিন নানা বিষয়ে সভা-সেমিনার আয়োজনের খবর পত্রপত্রিকায় আসে। মূলত আয়োজকেরা তাঁদের এসব অনুষ্ঠানের কাভারেজ পেতে সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোকে পছন্দ করেন।
অন্যান্য দিনের মতো বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) এমনই একটি গোলটেবিল অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ‘মঞ্চ ৭১’ নামের সদ্য জন্ম নেওয়া একটি সংগঠন। ‘আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের সংবিধান’ শীর্ষক এই আলোচনায় দেশের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নাগরিক অংশগ্রহণ করেছিলেন, যাঁদের মধ্যে কেউ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, কেউ ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং কেউ সাংবাদিক।
পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে থাকা কিছু ভিডিও ক্লিপে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, এই অনুষ্ঠান চলাকালে একদল মানুষ সেখানে গিয়ে হামলা করে, অতিথিদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে, নানা ধরনের স্লোগান দেয়। প্রথম আলোর খবর বলছে, এসব যুবক নিজেদের ‘জুলাইয়ের যোদ্ধা’ দাবি করেছে। অন্যান্য পত্রপত্রিকায় তাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসেবেও বলা হয়েছে।
অবরুদ্ধ ও লাঞ্ছিতের পর পুলিশ সেখানে গিয়ে অনুষ্ঠানস্থল থেকে ১৬ জনকে আটক করে গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে যায়, পরবর্তী সময়ে তাঁদের নামে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হয়েছে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের জানান।
গ্রেপ্তারের কারণ সম্পর্কে বিবিসি বাংলার এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকার গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান শফিকুল ইসলাম যা বলেছেন, তার সারমর্ম হচ্ছে আটক ব্যক্তিদের বক্তৃতা, বিবৃতি, বই, কলামের লেখা বিশ্লেষণ করে পুলিশ তথ্য-প্রমাণ যা পেয়েছে, তা রাষ্ট্রের অবস্থানের সঙ্গে কন্ট্রাডিক্টরি (বিরোধী)।
আমি নিশ্চিত নই, আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এই অল্প সময়ে ঠিক কোন কোন বই বা কলাম দেখে উপসংহারে টেনেছেন যে অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, সাংবাদিক মাহবুব কামাল, সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন, সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্নারা 'সন্ত্রাসবাদের' রসদ জোগান দিয়েছেন। তবে সেটিই যদি হয়, রাষ্ট্রের উচিত আমাদের এই শিক্ষক ও সাংবাদিকদের মুখোশ উন্মোচন করা। তাঁরা কোন বই, কোন কলাম, কোন টকশোতে ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তা জাতির সামনে তুলে ধরা। সেটি যদি করতে না পারে, তাহলে রাষ্ট্রের এই আচরণ হবে নিপীড়নমূলক, বাক্স্বাধীনতার পরিপন্থী অবস্থান।
সমালোচনা সহ্য করার সক্ষমতা না থাকলে যেকোনো সরকারের ভেতরে ‘কর্তৃত্ববাদী’ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। তাই পরমতসহিষ্ণুতা থাকা আমাদের বড্ড জরুরি। বিশেষ করে সমাজে যখন বিভাজন রেখা শাণিত হচ্ছে, তখন সরকারকে হাঁটতে হবে ঐক্যের পথে। সেটি করতে না পারলে দেশ দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার মধ্যে হাঁটবে। প্রতিশোধপরায়ণতা বাড়বে, রক্তপাত আমাদের সঙ্গী হয়ে উঠবে।
এখানে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন তৈরি হবে—এসব মানুষের কর্মকাণ্ডে যদি সত্যি সত্যি ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ অভিযোগ থাকে, তাহলে সরকার কেন তাঁদের অন্য সময়ে গ্রেপ্তার করল না? তাঁরা কি সবাই পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন? নাকি তাঁদের বিরুদ্ধে কেউ মামলা বা অভিযোগ দিয়েছিলেন?
রাষ্ট্রের এই আচরণ আমাদের মর্মাহত করে, পীড়া দেয়। বিশেষ করে যেভাবে ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, একদল যুবক আক্রমণ করছে, মারছে, অশ্লীল কথাবার্তা বলছে; সেখানে তাঁদের গ্রেপ্তার বা আটক না করে পুলিশ উল্টো উচ্ছৃঙ্খল যুবকদের হাতে লাঞ্ছিত ভুক্তভোগীদের গ্রেপ্তার দেখাচ্ছে। আটকের ১২ ঘন্টা পর তাঁদের কারাগারেও পাঠানো হলো।
মবের হাতে আক্রান্ত হওয়ার পর শুধু ডিআরইউর এই ঘটনা নতুন নয়। মবের হাতে নির্যাতিত হওয়ার পর সাবেক এক নির্বাচন কমিশনার থেকে শুরু করে নানা পেশার মানুষদের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর পত্রপত্রিকায় এসেছে।
এভাবে আর কত দিন আমরা চলব? বিষয়টি এমন হয়ে গিয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বললে ও সরকারের সমালোচনা করলেই সে আওয়ামী লীগের দোসর। তাঁদের বলা হচ্ছে, ‘কোমল আওয়ামী লীগার’। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পর যে রাজনৈতিক দলটি মুক্তিযুদ্ধকে নিজেদের ‘সম্পত্তি’ বানিয়ে ফেলেছিল, যাঁদের কাছে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ সরকারের নানা সুবিধা পাওয়ার অস্ত্র হয়ে গিয়েছিল, তাঁদের কাছ থেকে আমাদের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরব পুনরুদ্ধারের সুযোগ এবার তৈরি হয়েছিল। অথচ আমরা দেখলাম—মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলা, স্লোগান দেওয়াকে একদল মানুষ ভয় পাচ্ছে। অন্য দল সেখান থেকে ফায়দা লুটছে।
একসময় ছিল কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে যাঁরা কথা বলতেন, তাঁদের নামে এসব মামলা হতো। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট কিংবা সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ‘রাজনৈতিক’ প্রতিপক্ষদের দমন করত, জেলে পুরত। এখন এই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া সরকার যদি ঠিক শেখ হাসিনার পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেশ পরিচালনা করে, তাহলে যেসব মানুষ রক্ত দিয়ে পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন, তাঁদের কাছে এই সরকার কী জবাব দেবে?
শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে জন্ম নেওয়া বা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ যখন তাঁর বন্দনায় ব্যস্ত থাকত, মুক্তিযুদ্ধ-বঙ্গবন্ধু বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলত। সেই গোষ্ঠী সরকারের সমালোচনা কিংবা দানব হয়ে ওঠা মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পেত। এই ‘সুযোগসন্ধানীরা’ যখন গত বছরের ৫ আগস্টের পর অশরীরীও হয়ে গেছে, তাঁদের কোন পত্রপত্রিকা কিংবা টেলিভিশন টকশোতে খুঁজে পাওয়া যায় না।
তখন দেশের মুক্তিযুদ্ধ, মানবাধিকার, মবক্রেসি, দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচার নিয়ে সোচ্চার কিছু কণ্ঠস্বরকে আমরা দেখলাম, কিছু মানুষ সাহস করে বেশ কয়েক মাস ধরে কথা বলে যাচ্ছে, যাঁরা সরাসরি কিংবা পরোক্ষভাবে ছাত্র-আন্দোলনে শরিক হয়েছিল তাঁরা।
কিন্তু ২৮ আগস্ট যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁদের সবার একটি সাধারণ পরিচয় বহন করে। তা হলো মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অধ্যায়কে ধারণ করা। শেখ হাসিনা সরকারের সমালোচনা করার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ব্যতীত অধিকাংশ ব্যক্তিই আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
এবারও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নানা বিষয়ে তাঁরা সমালোচনা করে আসছেন। তাঁদের সমালোচনা কখনো গঠনমূলক হতে পারে, আবার কখনো না–ও হতে পারে। কিন্তু সমালোচনা সহ্য করার সক্ষমতা না থাকার খেসারত স্বরূপ জেলে ভরে দেওয়া, জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যায় না। মবদের প্রশ্রয় দিয়ে, তাঁদের হাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দুর্বল দেখিয়ে সরকার যে ‘কৌশলের’ আশ্রয় নিয়েছে, তাতে মানুষের ভেতর ভীতির সঞ্চার করছে, সাহস নয়। সমাজের সাধারণ মানুষ এই গুটিকয়েক মববাজের কাছে জিম্মি।
অথচ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ‘মোটো’ ছিল মানুষের ভেতরে জমে ওঠা ভীতিকর পরিস্থিতির চিরবিদায় জানানো। সমাজের সব শ্রেণির মানুষদের কথা বলার অধিকারকে শ্রদ্ধা জানানো; কিন্তু সরকার সেটি দেখাতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। বিশেষ করে মবকে দানব বানিয়ে সরকার নিজেদের যে ‘দুর্বলতার’ পরিচয় দিচ্ছে, তা আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার কাঠামোগুলোকে দুর্বল করে তুলছে।
সমালোচনা সহ্য করার সক্ষমতা না থাকলে যেকোনো সরকারের ভেতরে ‘কর্তৃত্ববাদী’ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। তাই পরমতসহিষ্ণুতা থাকা আমাদের বড্ড জরুরি। বিশেষ করে সমাজে যখন বিভাজন রেখা শাণিত হচ্ছে, তখন সরকারকে হাঁটতে হবে ঐক্যের পথে। সেটি করতে না পারলে দেশ দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার মধ্যে হাঁটবে। প্রতিশোধপরায়ণতা বাড়বে, রক্তপাত আমাদের সঙ্গী হয়ে উঠবে।
বিশ্বাস করি—সরকার ওসব গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের আইনি সুরক্ষা দেবে। জটিল কোনো অভিযোগ না থাকলে জামিন দেবে। আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠায় সর্বমতের গুরুত্ব অনুধাবন করবে।