বিভুরঞ্জনকে আমি তার শৈশবকাল থেকেই চিনি। আমাদের বামপন্থী আন্দোলনের একটি শক্তিশালী কেন্দ্র ছিল পঞ্চগড়ের বোদা। ওই বোদার ছেলে বিভু তার ছাত্রজীবনে প্রগতিশীল রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তার একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
এছাড়াও, ছাত্র ইউনিয়নের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবেও তিনি তৎপর ছিলেন। পরে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় আসার পর তার সঙ্গে আমার প্রকৃত পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। আমরা তখন কিছুটা সিনিয়র পর্যায়ে ছিলাম। তবে, আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনের সময় জগন্নাথ হলের একজন কর্মী হিসেবে আমি তাকে পাই।
স্বাধীনতার তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কাজে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হন। আমরা তখন ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা শুরু করি, যার নাম ছিল ‘জয়ধ্বনি’। এই পত্রিকার আনুষ্ঠানিক সম্পাদক যিনিই হোন, বিভুরঞ্জনই ছিলেন এর প্রধান কারিগর। ছাত্র ইউনিয়নের অন্যান্য সাংগঠনিক কাজ ও আন্দোলনের পাশাপাশি তিনি সাংবাদিক হিসেবে এই নতুন উদ্যোগে অংশ নেন, যা বাংলাদেশে আগে কখনো ছিল না। ছাত্রসমাজের মুখপত্র হিসেবে ‘জয়ধ্বনি’, যদিও সাপ্তাহিক ছিল, খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এটি নতুন অবয়ব ও নতুন উপাদান ছাত্র সমাজের সামনে নিয়ে আসে।
এই দায়িত্ব পালনের সময়ই আমার ছাত্রজীবন শেষ হয়ে যায়। তার সঙ্গে যতটা সংযোগ ছিল, তা আর ততটা থাকে না। কিন্তু পরে, যখন আমি জেল থেকে মুক্ত হয়ে আশির দশকে কাজ শুরু করি, তখন আবার তার সঙ্গে সংযোগ ঘনিষ্ঠ হয়। ‘একতা’ পত্রিকা, যা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ছিল, সেখানে মতিউর রহমান প্রধান ছিলেন। মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু, বিভুরঞ্জন সরকারসহ একটি টিম গড়ে ওঠে। তার সাংবাদিকতার দক্ষতা মূলত এই সময়ে ‘একতা’য় কাজ করার মাধ্যমে গড়ে ওঠে।
আমি স্বীকার করব, আমার লেখা সংগ্রহ করা এবং লেখার স্টাইল, বানান বা শব্দচয়নে আমার যে সংকট ছিল, তা কাটিয়ে উঠতে বিভুরঞ্জনের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। আমার লেখাগুলো তিনি দেখে গুছিয়ে সম্পাদনা করতেন। এতে আমি ভরসা পেতাম। তার জন্যই আমার কিছু লেখা ‘একতা’য় ছাপা হয়েছিল। পরবর্তীকালে যখন আমি কলাম লিখতে শুরু করি, তার এই সহায়তা আমার কাজে লেগেছিল।
সাংবাদিকতার জগতে নানা উত্থান-পতন ও ভালো-মন্দ প্রবণতার মধ্যে তার অবস্থান কখনো এখানে, কখনো সেখানে ছিল। দীর্ঘদিন তিনি ‘যায়যায়দিন’ পত্রিকায় যুক্ত ছিল। কিন্তু কোনো জায়গাতেই ভালোভাবে থিতু হতে পারেননি।
রাজনৈতিকভাবে বিভু কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত বজায় রাখেননি। তবে আমি বলব, প্রগতিবাদী চিন্তাধারা থেকে তিনি কখনো দূরে সরে যাননি। শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং ন্যয়বিচার-ইনসাফের পক্ষে সবসময় দৃঢ়ভাবে কলম ধরেছেন।
আমার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কটার আরেকটা মাত্রা আছে। বেশ কিছুদিন আমরা কাছাকাছি বাসায় থাকতাম। তিনি যখন প্রথম সংসার শুরু করেন, ওই সময় তার বাসাটা আমার বাসার কাছেই ছিল। ওই সূত্রে একটা পারিবারিক সম্পর্কও কিছুদিনের জন্য গড়ে ওঠে।
তার ছেলে যখন অসুস্থ হয়ে অল্প বয়সে পিজি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি, আমি একাধিকবার সেখানে গিয়ে তাকে ভরসা দিয়েছি, সাহস দিয়েছি। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছি। আমাদের সবাইকে আশ্বস্ত করে তার ছেলে যখন কঠিন রোগ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠেন, তা বিভুর জন্য স্বস্তির বিষয় ছিল।
আরেকটা ঘটনা না বললেই নয়। ‘মাতৃভূমি’ নামে একটা পত্রিকা ছিল। তখন এটির ডিক্লারেশন শূন্য ছিল। বিভুরঞ্জন উৎসাহের সঙ্গে আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেন যে, আমরা কেন এই পত্রিকাটি আমাদের পার্টির পক্ষ থেকে পরিচালনার দায়িত্ব নিচ্ছি না? তার পরামর্শ ও পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা প্রায় এক বছর ধরে পত্রিকাটি চালাতে সক্ষম হই। তিনি এর প্রধান সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। দুঃখজনকভাবে, পরে পত্রিকাটি আর চলেনি এবং হস্তান্তর হয়ে যায়।
কিছুদিন আগেও তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলোচনা হয়েছে। তার মধ্যে একটি বিমর্ষ ভাব, একটা হতাশার ভাব ছিল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক কিছু—তিনি কীভাবে চলছেন, কী চিন্তা করছেন, এগুলো নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। সেই সুরটা আমি পেয়েছিলাম যে, তিনি একটা হতাশার ভেতরে আছেন। রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়েও তার অবস্থান ছিল বিক্ষুব্ধ। কিন্তু আমার মনে কখনো সন্দেহ হয়নি যে, বিভু জীবন থেকে বিদায় নেওয়ার কথা ভেবেছেন। তার মৃত্যুর সংবাদ আমার কাছে আকস্মিক ও মর্মান্তিক। এই মৃত্যু ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
সাংবাদিক হিসেবে তার নিবন্ধ লেখা বা কলাম লেখার অসাধারণ দক্ষতা ছিল। একটা আইডিয়া বলে দিলে, একটা পয়েন্ট বলে দিলে খুবই সুন্দর করে লিখে ফেলতে পারতেন। কিন্তু ওই যে, তার ক্যারিয়ার কোথায় থাকবে, কার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকবে, এটার ব্যাপারে একটা অস্থিরতা সবসময় কাজ করেছে। সন্তুষ্টি নিয়ে কাজ করতে পারেননি।