অবশেষে আগামীকাল দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিপীড়ন, দীর্ঘ প্রবাসজীবন এবং শোককে পেছনে ফেলে তাঁর দেশে ফেরাকে ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন হিসেবে দেখছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।
২০০৮ সালে দেশের মাটিতে মায়ের সঙ্গে তারেক রহমানের শেষ দেখা হয়েছিল। সে সময় বিশেষ কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েই সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন ছেলে তারেক রহমানকে দেখতে যান। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে যেতে হয়। লন্ডনে অবস্থানকালে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের রাজনৈতিক চাপ ও মামলার বেড়াজালে পড়ে দীর্ঘদিন দেশে ফিরতে পারেননি তিনি।
তারেক রহমানের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় খুব অল্প বয়স থেকেই। তাঁর বয়স যখন ছয় বছর, তখন শুরু হয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধকালীন সময়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যখন রণাঙ্গনে, তখন তারেক রহমানকে ছোট ভাইসহ মা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে কারাবন্দী থাকতে হয়।
১৯৮৬ সালে তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল এইচ এম এরশাদ সরকারের পাতানো নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠেন তারেক রহমান। ওই সময় তিনি গৃহবন্দিত্ব এড়িয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন। সেখানে তিনি অভিযোগ করেন, নিরাপত্তা সংস্থাগুলো একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে আন্দোলন দমন করতে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করছে।
এই সংবাদ সম্মেলনের পর তার কণ্ঠরোধের উদ্দেশ্যে এরশাদ সরকারের নির্দেশে তাকে একাধিকবার তার মায়ের সঙ্গে গৃহবন্দী করে রাখা হয় বলে অভিযোগ উঠে। তবুও রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে সরে যাননি তিনি।
এরশাদবিরোধী গণআন্দোলনের সময় তারেক রহমান তার মা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে রাজপথে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
তার আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৮ সালে। পিতৃভূমি বগুড়ার গাবতলী উপজেলা বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে প্রচারণায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ২০০১ সালের নির্বাচন-পূর্ব সময়ে তৃণমূলের সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধানের লক্ষ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা শুরু করেন। ২০০২ সাল থেকে ধীরে ধীরে দলের নেতৃত্বে উঠে আসেন। ২০০৫ সালে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে গ্রামেগঞ্জে দল সংগঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
২০০৭ সাল ছিল তারেক রহমানের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ওই বছরের ৭ মার্চ ঢাকার মইনুল রোডের বাসা থেকে বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে চোখ বেঁধে প্রায় ১৮ ঘণ্টা অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয় তাঁর ওপর। একই বছরের ২৮ নভেম্বর আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সেই নির্যাতনের বর্ণনা তুলে ধরেন তিনি।
রিমান্ড ও নির্যাতনের মধ্য দিয়ে ৫৫৪ দিন বা প্রায় ১৮ মাস কারাভোগের পর গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মুক্তি পেলেও তাঁর ঘরে ফেরা হয়নি। হাসপাতাল থেকেই ১১ সেপ্টেম্বর তাঁকে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে যেতে হয়।
লন্ডনে যাওয়ার পরও তাঁর বিরুদ্ধে মামলার চাপ থামেনি। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাঁর বিরুদ্ধে ১৩টি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৭২টি মামলা করা হয়। এর মধ্যে অন্তত পাঁচটি মামলায় তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। এমনকি আদালতের মাধ্যমে গণমাধ্যমে তাঁর বক্তব্য প্রচারের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
২০০৯ সালে তারেক রহমান বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে দল পুনর্গঠনে সক্রিয় হন তিনি। ২০১৮ সালে তাঁর মা, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দী হলে তারেক রহমানকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মনোনীত করা হয়। এরপর থেকে তিনি শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর একে একে সব মামলা থেকে খালাস পান তারেক রহমান। বিএনপির আইনজীবীরা জানান, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাহী আদেশে মামলা প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিলেও তা গ্রহণ না করে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তিনি মামলামুক্ত হন।
দলীয় আইনজীবীদের ভাষ্য, তারেক রহমান একজন নিরপরাধ ব্যক্তি হিসেবেই দেশে ফিরছেন, যদিও এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ আইনি লড়াই ও রাজনৈতিক সংগ্রাম।
নেতাকর্মীদের দাবি, ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নেপথ্যের গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। আন্দোলনে কর্মীদের সংগঠিত ও উজ্জীবিত করতে তিনি কৌশলী ভূমিকা রাখেন। সরকার পতনের আন্দোলনের পাশাপাশি রাষ্ট্র মেরামতের সংস্কার ভাবনা ও রাজনৈতিক সরকারের গুরুত্ব তুলে ধরে নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে আসেন তিনি।
সব জল্পনা-কল্পনা ও উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে আগামী ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
সাননিউজ/আরআরপি