ছবি : সংগৃহিত
মতামত

পুষ্টি চাহিদা পূরণে পোলট্রি শিল্প দেশ উপযোগী

মো: মাঈন উদ্দীন : পোল্ট্রি শিল্প বাংলাদেশের জন্য মানানসই ও উপযোগী শিল্প। কেননা, দেশের পুষ্টির চাহিদা পূরণে এই খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। অল্প পুঁজিতে স্বল্প জায়গায় গড়ে উঠা এই শিল্প উন্নত আমিষের উৎস।

আরও পড়ুন : স্বাধীনতা দিয়েছে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা দিয়েছে সমৃদ্ধি

আত্মকর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও এ শিল্পের অবদান রয়েছে। গোশত, ডিম সরবরাহের মাধ্যমে পোল্ট্র্রি খাত দেশের প্রোটিন ঘাটতি পূরণে ভূমিকা রেখে চলেছে। গোশত, ডিম, পশুখাদ্য, ওষুধ তৈরির উপকরণের মতো অর্থনৈতিকভাবে মূল্যবান দ্রব্য উৎপাদনকারী গৃহপালিত পাখি, হাঁস-মুরগি, কোয়েল, কবুতর, রাজহাঁস, হাঁস পরিপালন পরিচর্যা সাধারণত পোল্ট্রি হিসেবে বিবেচিত। অর্থনীতিতে প্রাণিসম্পদ খাতের মধ্যে পোল্ট্রি খাত অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ উপখাত।

করোনা মহামারী ও রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে বৈশিক সঙ্কটে পোল্ট্র্রি খাদ্যের উচ্চমূল্যর কারণে এ শিল্পের উন্নয়ন, উৎপাদন, বিপণন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। করোনার আগেও নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত খামারের সংখ্যা ছিল এক লাখ ৫৮ হাজার ১৭৯।

বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিআইএ) তথ্য মতে, করোনার পর ৪০ শতাংশ খামার অর্থাৎ ৬২ হাজার ৬৫৬টি খামার বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হওয়া খামারের মধ্যে লেয়ার খামার ১১ হাজার ১২৭টি। ব্রয়লার খামার ৩১ হাজার ৯৭২টি। সোনালি খামার ১২ হাজার ৬৪৮টি ও ছয় হাজার ৯০৯টি হাঁসের খামার বন্ধ হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন : বিশ্ব স্বীকার করুক পাকিস্তানিরা গণহত্যা চালিয়েছিল

বিপিআইয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে খামারগুলোতে মুরগির গোশতের উৎপাদন সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। সক্ষমতার চেয়ে ২৫.৭১ শতাংশ কম। আর দৈনিক ডিম উৎপাদন সক্ষমতা ছয় কোটি ৬৪ লাখ ৮২ হাজার ১৮৩টি হলেও উৎপাদন হচ্ছে চার কোটি ৩২ লাখ ১৩ হাজার ৪১৮টি। তথ্য মতে, প্রতি কেজি বয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ১৬৭.২৮ টাকা।

ঢাকার বাজারে এই মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৪০-২৬০ টাকা দামে। এ দামটি কোনো দিক থেকেই যৌক্তিক নয় আবার এটিও ঠিক যে, খামারের জন্য পোল্ট্র্রি খাতে উৎপাদনের উপকরণের দাম পোল্ট্র্রি ফিডসহ অন্যান্য উপকরণের অত্যধিক দামও বৃদ্ধি পেয়েছে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, পোল্ট্র্রি উৎপাদনে মোট খরচের শতকরা ৬৫ থেকে ৭৫ ভাগ শুধু খাবারের পেছনে যায়। এ জন্য পোল্ট্রি খাবারের বা ফিডের দাম কমানো বা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। এই শিল্পের উন্নয়ন, উৎপাদন বৃদ্ধি ও কর্ম সংস্থান বৃদ্ধির জন্য পোল্ট্রি সাথে সংযুক্ত উপকরণ, খাদ্য ও শুল্প কমানোর বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ পদক্ষেপ নেয়া উচিত। দেশের পুষ্টির চাহিদা পূরণ, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করণ ও মানুষের স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষার জন্য ভোক্তারা যাতে ডিম ও মুরগির মাংস সাধ্যের মধ্যে কিনতে পারে সে ব্যবস্থা করা উচিত। যাতে হ্যাচারি মালিকরাও লাভবান হয়। সেই দিকটিও দেখা উচিত- গত ২০০৭-০৮ ও ২০১১ সালের দিকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বার্ড ফ্লু দেখা দিলে তখন বহু খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তখন ডিম ও মুরগির উৎপাদনে অনেক ঋণাত্মক প্রভাব দেখা গিয়েছিল।

আরও পড়ুন : শ্রীলঙ্কার পর অর্থনৈতিক সংকটে পাকিস্তান

এ জন্য পোল্ট্র্রি খাতের এ মারাত্মক ঝুঁকি থেকে সুরক্ষার জন্য খামারিদের সচেতন হওয়া ও প্রয়োজনীয় পরিচর্যার সময় উপযোগী পদক্ষেপ নেয়া উচিত। পোল্ট্র্রি খামারের পশু-পাখি, হাঁস-মুরগির সুস্বাস্থ্য রাখা জীবাণুমুক্ত পরিচর্যা আরো নিখুঁত করার জন্য কর্মী ও শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং তদারকি করা উচিত। রোগ প্রতিরোধের জন্য ভ্যাকসিনের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা উচিত।

সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে ক্লাস্টার-ভিত্তিক বিভাজন করে খামারের উৎপাদন খরচ কমানো, প্রয়োজনীয় ফিড সহজলভ্য করা, উপযুক্ত টিকা-ভ্যাকসিন দেয়া নিশ্চিত করা উচিত। খামারিরা বাচ্চা কিনে যদি খাবারের দাম বৃদ্ধির কারণে বাচ্চা পালন করতে হিমশিম খায় তাহলে উৎপাদন হ্রাস পাবে, পোল্ট্র্রি খামার বন্ধ হয়ে যাবে, অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে, খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। ফলে মুরগি ও ডিমের দাম বেড়ে যাবে। এতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিদের জীবন যাত্রা আরো কঠিন হয়ে যাবে।

সাধারণত একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে যদি অন্ত্যত ডিম ও মুরগির গোশত থাকে তাহলে ন্যূনতম মেহমানদারিসহ তাদের নিজেদের জীবন মোটামুটিভাবে চলতে পারে। তাই পোল্ট্রি শিল্পের মতো এ গুরুত্বপূর্ণ খাতকে নানা ঝুঁকির হাত থেকে মুক্ত করে এগিয়ে নিতে হবে। টেকসই উন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য পোল্ট্র্রি খামারগুলোকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। তাদের উৎপাদন খরচ কমাতে হবে, বাজার তদারকি জোর দার করতে হবে যাতে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি ও দাম বাড়াতে কালোবাজারি করতে না পারে। এ খাতে বিনিয়োগ সহজলভ্য করতে হবে।

আরও পড়ুন : নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে শিখুন

বিদেশ থেকে যেসব উপকরণ আমদানি করতে হয় তাতে শুল্ক-ভ্যাটসহ আমদানি খরচ কমানো উচিত। দেশের অনুন্নত ফিড মিলগুলোকে উন্নত করার পদক্ষেপ নেয়া উচিত। আধুনিক ফিডমিল স্থাপন করে পরিবেশ সুরক্ষায় ভূমিকা পালন করতে হবে।

পোল্ট্র্রি, গবাদিপশু ও মাছের খামারগুলোর মধ্যে বর্তমানে বাণিজ্যিক ফিড বাজারে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি পোল্ট্রি ফিড রয়েছে। পোল্ট্র্রি ফিডের মধ্যে ১০-১৫ শতাংশ ফিড লাগে ব্রিডার ফার্মের জন্য। আর বাকি ৮৫-৯০ শতাংশ ফিড লাগে এক দিনের বাচ্চা থেকে শুরু করে ব্রয়লার ও লেয়ার ফার্মের জন্য। প্রয়োজনীয় সময়ের মধ্যে যথাযথভাবে ভালো মানের ফিড সরবরাহ করলে এই শিল্পের প্রবৃদ্ধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধির ব্যাপক সম্ভাবনা হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ফিডের দাম বাড়ায় বিশেষ করে ডলারের দরজনিত আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে ভুট্টা ও সয়াবিনের দাম বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে শুল্ক ভ্যাট কামানোর জন্য ব্যবসায়ীরা দাবি জানিয়ে আসছে। আবার কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বাজারের অযৌক্তকভাবে মূল্য নির্ধারণ করে ও কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে বাজারকে অস্থিতিশীল করে। এ ক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তদারকি বাড়ানো উচিত।

আরও পড়ুন : দুর্ঘটনায় নিহতদের জীবনের মূল্য কত?

বর্তমানে পোল্ট্রি খাতে সমস্যাগুলোর মধ্যে বড় সমস্যা হলো সিন্ডিকেট। এ খাত ঘাটে ঘাটে সিন্ডিকেটের কবলে বন্দী। যেমন- ডিম সিন্ডিকেট, ফিডের ক্ষেত্রে আর এক ধরনের সিন্ডিকেট, ওষুধ, ভুয়া ওষুধ সিন্ডিকেটসহ চিকিৎসা ক্ষেত্রেও নানা সিন্ডিকেটের জালে বন্দী এ খাত। এসব সিন্ডিকেট বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

সিন্ডিকেটের কারণে অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। প্রায় ১৭ লাখেরও বেশি লোকের জীবিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ খাতের সাথে সম্পৃক্ত। এ শিল্পের ক্ষত দিন দিন বৃদ্ধি পেলে বেকারত্বও বাড়তে থাকবে, বন্ধ হয়ে যাবে খামারগুলো। ফলে পুষ্টির জোগানে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবার কাছে ডিম ও মুরগির গোশতের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে।

শিশুরা আজ মাছ খেতেই চায় না। কিন্তু ডিম ও গোশত পেলে খুশি হয়। আমিষ প্রাপ্তি ও সরবরাহের এ গুরুত্বপূর্ণ খাতটির ব্যাপক উন্নয়ন ও উৎপাদন খরচ কমানোর পাশাপাশি প্রশিক্ষিত খামারিদের দ্বারা পরিচালনা করা উচিত।

আরও পড়ুন : নারীর চ্যালেঞ্জ, নারীর অগ্রযাত্রা

প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের খামারিদের প্রশিক্ষণের জন্য ভ্রাম্যমাণ কর্মসূচি নেয়া উচিত। প্রতিটি উপজেলায় প্রশিক্ষিত টিম গঠম করে তৃণমূল খামারিদের মধ্যে সচেতনামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। খামার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিরাপদ পানি ও জীবাণুমুক্ত পরিবেশ বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। মুরগির চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনমাফিক ও যথোপযুক্ত ওষুধ প্রয়োগে তদারকি থাকা উচিত। বন্ধ হয়ে যাওয়া খামারগুলো চালুর উদ্যোগ নেয়া উচিত।

আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত খামারগুলোকে সহজশর্তে ঋণ প্রদান ও ঝুঁকিতে থাকা খামারগুলোর তালিকা করে তা সুরক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত। ডিম ও মুরগির গোশত সহজলভ্যতা এবং আমিষ প্রাপ্তির গুরুত্বপূর্ণ এ খাতটিকে হেলা করা ঠিক হবে না। ধনী-দরিদ্র সবার কাছে এ খাতের চাহিদা শীর্ষে।

কাজেই সরকার ও সংশ্লিষ্ট দফতর পোল্ট্রি খাতের টেকসই উন্নয়ন ও সমস্যা নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে শৃঙ্খলা আনয়ন করে খামারভিত্তিক অর্থনীতিকে মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো উচিত। এতে প্রান্তিক পর্যায়ে খামারিদের জীবিকা নির্বাহ উন্নয়নসহ দেশের অর্থনীতির চাকা আরো গতিশীল হবে বলে সবার প্রত্যাশা।

আরও পড়ুন : আমাদের বিমান কাদের হাতে?

লেখক :

অর্থনীতি বিশ্লেষক

ইমেইল : [email protected]

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

ব্রাজিলে মাদকচক্রবিরোধী অভিযানে ৪ পুলিশসহ ১১৯ জন নিহত

ব্রাজিলে মাদকচক্রের বিরুদ্ধে এক বড় পুলিশি অভিযানে...

২০৩৪ সালের ট্রিলিয়ন ডলারের লক্ষ্য অর্জনে নারীই চালিকাশক্তি: তারেক রহমান

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, “আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি স...

নির্বাচনের আগে গণভোট অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয়

আগামী এয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক বলে মন্তব্য...

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জবাবদিহির আওতায় আনছে সরকার

জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের, এ কথা জানিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্...

‘হ্যাঁ’ ভোটে বিএনপির জন্ম, ‘না’ ভোটে মৃত্যু

জামায়াত ও বিএনপি কুতর্ক বাদ দিয়ে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে এগিয়ে আসার আহ্বান জা...

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জবাবদিহির আওতায় আনছে সরকার

জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের, এ কথা জানিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্...

বোয়ালমারীতে দুর্ধর্ষ ডাকাতি, স্বর্ণালঙ্কারসহ কোটি টাকার মালামাল লুট

ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে নারায়ণ চন্দ্র নামে এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে দুর্ধর্ষ ডাকাতির...

জনগণের সিদ্ধান্ত নাকি রাজনীতির সাজানো সম্মতি?

গণভোট হলো জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণের একটি পদ্ধতি, যে...

এবার ইসির প্রতীক তালিকায় যুক্ত হলো ‘শাপলা কলি’ 

নির্বাচন বিধিমালা ২০০৮ সংশোধন করে সংরক্ষিত প্রতীকের তালিকায় নির্বাচন কমিশন যু...

সুন্দরবনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বনদস্যু, তিন শতাধিক জেলে অপহরণ

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ও মৎস্যভান্ডার নামে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা