দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই খাগড়াছড়িতে চলছে পাহাড় কাটার মহোৎসব। রাতে ও দিনে পাহাড়খেকোরা ফেলোডার (ভ্যাকু) মেশিন দিয়ে পাহাড় কাটার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। এই অব্যাহত ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকাতে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি একাধিক সংঘবদ্ধ চক্র রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে কেটে ফেলেছে পৃথিবীর খুঁটি নামক এই টিলাভূমি, যা বিপর্যয়ের এক অশনিসংকেত।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জেলার মাটিরাঙা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন যেমন— তাইন্দং, তবলছড়ি, বর্ণাল, রামশিরা, বেলছড়ি, গোমতি, মাটিরাঙা সদর ও পৌরসভাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে নির্বিচারে মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে। আইন অমান্য করে ফেলোডার (ভ্যাকু), কোদাল ও শাবল দিয়ে ফসলি জমির টপসয়েল ও লাল মাটির পাহাড় কাটা হচ্ছে। যার ফলে পাহাড়ের ওপরের অংশ ন্যাড়া করে উজাড় করা হয়েছে গাছপালা। কোথাও খাড়া ভাবে, আবার কোথাও কাটা হচ্ছে আড়াআড়ি ভাবে। আর কিছু কাটা হচ্ছে উঁচু চূড়া থেকে। এভাবে হরেক রকম কায়দায় বেপরোয়া ভাবে কাটা হচ্ছে বিভিন্ন পাহাড়।

অপরদিকে গোমতি ইউনিয়নের গরগরিয়ায় রাতের অন্ধকারে কৃষি জমির টপসয়েল কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। তাইন্দং, তবলছড়ি পুলিশ ফাঁড়ির সন্নিকটে পাহাড় কাটলেও কোনো এক অদৃশ্য কারণে নিরব পুলিশ প্রশাসন। তবলছড়ির শুকনাছড়িতে মাটিরাঙা–তানাক্কাপাড়া আঞ্চলিক সড়কের পাশে পাহাড় কেটে কৃষি জমি ভরাট করা হচ্ছে। প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পাহাড় কেটে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, আগেও মাটি কাটা হতো, তবে এভাবে মাটি কাটার দৃশ্য আগে চোখে পড়েনি। ৫ আগস্ট দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর খাগড়াছড়িতে পাহাড় কাটার মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যায়। তাদের দাবি, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগে এলাকায় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের নাম ভাঙিয়ে পাহাড়খেকো চক্রটি দীর্ঘদিন ধরেই পাহাড় কাটা অব্যাহত রেখেছে। নতুন ক্ষমতার সমীকরণ তৈরি হওয়ার পর সেই দৌরাত্ম্য আরও বেপরোয়া রূপ নিয়েছে। পাশাপাশি প্রশাসন নিরব থাকায় দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে পাহাড় কাটার এই ধ্বংসলীলা।
অন্যদিকে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন কাজের অজুহাতে এস্কেভেটর (ভ্যাকু) ভাড়া করে এনে ইউনিয়ন পরিষদের সচিবদের ঢাল হিসেবেও ব্যবহার করেন এই চক্রটি। জনশ্রুতি রয়েছে পাহাড়খেকো সিন্ডিকেটের সাথে গোপন চুক্তিতে পাহাড় কাটায় সহযোগিতা করছে ইউপি সচিবরা।
২নং তবলছড়ি ইউপি সচিব ওসমানের নিকট এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সহযোগিতার কথা অস্বীকার করে বলেন, “আমার নাম ভাঙিয়ে কে বা কারা এসব কাজ করে আমার জানা নেই। তবে ইউনিয়ন পরিষদের টিআর ও কাবিখা প্রকল্পের কিছু কাজের জন্য এস্কেভেটর (ভ্যাকু) ভাড়ায় আনা হয়েছে। সরকারি কাজের বাইরে অন্য কোনো কাজের সাথে তার সম্পৃক্ততা নেই।”
এদিকে পাহাড় কাটা বন্ধে প্রশাসন জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও পাহাড়ে তা মানা হচ্ছে না। জেলার দীঘিনালা, মাটিরাঙা, রামগড়, গুইমারা ও খাগড়াছড়ি জেলা সদরে সবচেয়ে বেশি পাহাড় কাটা চলছে।
প্রচলিত আইন অমান্য করে পাহাড় কাটায় ক্ষোভ জানান পরিবেশবাদীরা।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধনী ২০১০):
এই আইনের ৬(খ) ধারা অনুযায়ী সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড়/টিলা কাটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র সাপেক্ষে কাটা যেতে পারে।
এতে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে— প্রথম অপরাধে ২ বছর জেল ও ২ লক্ষ টাকা জরিমানা; পরবর্তী অপরাধে ১০ বছর জেল ও ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত।
পরিবেশ অধিদপ্তর খাগড়াছড়ির সহকারী পরিচালক হাছান আহমেদ জানান, পাহাড় কাটা বন্ধে জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি পরিবেশ অধিদপ্তরও কাজ শুরু করেছে। অবৈধভাবে পাহাড় ও টিলা কাটার ঘটনায় সম্প্রতি মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। দুটি ঘটনায় আদায় করা হয়েছে পরিবেশগত ক্ষতিপূরণ।
মাটিরাঙা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহমুদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, “আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হয়েছি। বিভিন্ন প্রশাসনের সাথে কথা হয়েছে। খুব শীঘ্রই ফেলোডারগুলো জব্দ করা হবে।”
সাননিউজ/আরআরপি