প্রকৃতিতে এখন শীতের হিমেল বাতাস বইতে শুরু করেছে। পুরোপুরি শীত না নামলেও আগাম প্রস্তুতি নিতে লেপ–তোষক বানাতে ক্রেতারা ভিড় করছেন দোকানগুলোতে।
বাগেরহাটের ৯ উপজেলায় দিনের বেলা রোদ ঝলমলে থাকলেও ভোরের কুয়াশা, সন্ধ্যার হিমেল হাওয়া আর শেষ রাতের শীতের ছোঁয়া জানান দিচ্ছে—শীত আর দরজার বাইরে নেই। শীতের এই বার্তা প্রকৃতিতে আসার সঙ্গে সঙ্গে বুননকারীদের তুলা ছাঁটাই ও লেপ–তোষক–জাজিম তৈরির কাজে বেড়েছে কর্মচাঞ্চল্য।
দিন–রাত থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সুই–সুতা আর ফিটিংয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা। শীত যত ঘনিয়ে আসছে ততই বেড়েছে লেপ–তোষকের কদর। সেই সঙ্গে বেড়েছে কারিগরদেরও কদর। কেউ তুলা কিংবা পুরোনো লেপ ভেঙে তৈরি করছেন লেপ–তোষক, জাজিম, বালিশ।

মোরেলগঞ্জ বাজারের লেপ–তোষক ব্যবসায়ী শহিদুল ফরাজী জানান, মৌসুমের শুরুতেই বিক্রি গত বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্ডারের চাপ দ্বিগুণ হবে বলে তাদের আশা। তবে কাপড়–তুলার চড়া দাম কারিগরদের চিন্তায় ফেলেছে। তুলা ও কাপড়ের দাম গত বছরের তুলনায় বেড়েছে ১০–২০ শতাংশ।
বাজারে নিত্যপণ্যের মতোই বাড়ছে লেপ–তোষক–জাজিম তৈরির খরচ। প্রতি কেজি কার্পাস তুলা ৩৫০–৪০০ টাকা, শিমুল তুলা ৫০০–৭০০ টাকা, আঙ্গুরি তুলা ১২০–১৪০ টাকা এবং জুট ৮০–১০০ টাকা।
লেপ তৈরি করতে আসা গাবতলা গ্রামের দিনমজুর আবদুল লতিফ শেখ বলেন, “আমরা গরিব মানুষ, কম্বল কেনার সামর্থ্য নেই। দিনের বেলা শীত কম থাকলেও রাতে অনেক শীত পড়ে। তাই অল্প টাকায় লেপ তৈরি করে নিচ্ছি।”
মোরেলগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, “ক্রেতার সুবিধার কথা চিন্তা করে আগেভাগেই লেপ–জাজিম বানিয়ে দোকানে মজুত রাখা হয়েছে। কারণ শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লেপ–তোষকের চাহিদা বেড়ে যায়, তখন সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হয়।”
কারিগররা জানান, একটি লেপ–তোষক তৈরিতে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা মজুরি নেন। আকার অনুযায়ী ২–৩ ঘণ্টা সময় লাগে। তাই মৌসুম শুরু থেকে দম ফেলার সময় থাকে না। ব্যবসায়ীরা জানান, পুরো বছরের চেয়ে শীতের এই তিন মাসেই বিক্রি তুলনামূলক বেশি থাকে।
লেপ তৈরি করতে আসা ভাইজোরা গ্রামের সাথী ইসলাম বলেন, “শীতের মোকাবিলায় আগেভাগেই লেপ বানিয়ে নিচ্ছি। একটি নতুন আর একটি পুরোনো লেপ নতুন করে তৈরি করছি। তবে তুলনামূলক খরচটা অনেক বেশি হচ্ছে।”
সাধারণত লেপের কাভারের রঙ লাল হওয়ার পেছনে রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। বাংলায় লেপের প্রাচীনত্ব খুঁজে পাওয়া যায় নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর আমল থেকে। সেই সময় মুর্শিদাবাদ কারুকার্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। লম্বা আঁশের কার্পাস তুলা বীজ ছাড়িয়ে লাল রঙে চুবিয়ে শুকিয়ে নরম সিল্ক বা মখমলের কাভারে ভরা হতো। সেই থেকে লাল রঙের ঐতিহ্য গড়ে ওঠে।
শুধু তাই নয়, লেপে সুগন্ধের জন্য আতরও ব্যবহৃত হতো, যা লেপকে শুধু উষ্ণ রাখত না, বরং তার মর্যাদা ও সৌন্দর্যও বৃদ্ধি করত। সেই সময় বিহারসহ অবিভক্ত বাংলার নবাবরাও এ রীতিটি অনুসরণ করতেন।
নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর মেয়ের জামাই নবাব সুজাউদ্দিন মখমলের পরিবর্তে সিল্ক কাপড় ব্যবহার শুরু করেন, তবে রঙের কোনো পরিবর্তন আনেননি—লাল রঙই বহাল থাকে।
সময়ের বিবর্তনে মখমল ও সিল্ক সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেলেও পরবর্তী সময়ে সাধারণ কাপড়ের ব্যবহার শুরু হয়। তবুও লেপের রঙ আজও লালই—যা বাংলাদেশের শীতকালীন লেপের একটি ঐতিহ্যবাহী বৈশিষ্ট্য হিসেবে সমাদৃত।
সাননিউজ/আরপি