শীতের মাত্রা যত তীব্র হচ্ছে, ততই যেন হোসিয়ারি পল্লীতে ব্যস্ততা বাড়ছে। পরিবারের সকল সদস্য নিরলসভাবে কাজ করছেন। কেউ চরকায় সুতা কাটছেন, কেউ ব্যস্ত রং করতে ব্যস্ত। অনেক কারখানায় ঘুরছে আধুনিক মেশিনের চাকা। দিন-রাত খুটখাট শব্দে মুখর হোসিয়ারি পল্লী।
ঘরে ঘরে সোয়েটার, মোজা, কার্ডিগান, মাফলার, টুপি, বাচ্চাদের বিভিন্ন নকশার শীতের পোশাক তৈরিতে ব্যস্ত এখন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার হোসিয়ারি পল্লীর মানুষ। নারী কিংবা পুরুষ, কিশোর বা বৃদ্ধ—সবাই ব্যস্ত নিজ নিজ কাজে।
শীত মৌসুম এলেই শীতবস্ত্র তৈরি ও বিক্রিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে কারিগর ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। সারা দেশ থেকে আসে পাইকার। তাদের মাধ্যমেই মৌসুমজুড়ে সাশ্রয়ী মূল্যে সোয়েটার, কার্ডিগান, মোজা, মাফলারসহ বিভিন্ন শীতবস্ত্র ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
শুরুতে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কোচাশহর মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নে হোসিয়ারি শিল্পের বিস্তৃতি থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পার্শ্ববর্তী শালমারাসহ কয়েকটি ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রামজুড়ে গড়ে উঠেছে হোসিয়ারি শিল্পের ছোট-বড় কারখানা।
বর্তমানে কারখানাগুলোতে চলছে কর্মব্যস্ততা ও বেচাকেনা। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, স্বাধীনতার আগে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কোচাশহর এলাকার এক ব্যক্তি প্রথমে ঢাকা থেকে সোয়েটার বানানোর কাজ শিখে এসে নিজ এলাকায় সেই কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে হোসিয়ারি শিল্পের গ্রামে পরিণত হয় এ এলাকা।
এখন বাড়ি বাড়ি গড়ে উঠেছে হোসিয়ারি শিল্পের কারখানা। কোনো বাড়িতে হাতে, আবার কোনো বাড়িতে আধুনিক মেশিনে তৈরি হচ্ছে সোয়েটার, কার্ডিগান, মোজা, মাফলারসহ বিভিন্ন শীতের পোশাক। বাড়িতে ছোট ছোট কারখানা করে স্বাবলম্বী হচ্ছে মানুষ। দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ করলেও এখন বাড়িতে থেকেই কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে এলাকার কয়েক হাজার পোশাক শ্রমিক।
উপজেলার নয়ারহাট এলাকার আমিনুল ইসলাম বলেন, আগে ঢাকায় কাজ করতাম। এখন বাড়িতে থেকে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছি। এখন বাসা ভাড়াসহ অন্যান্য বাড়তি খরচ নেই। আমার মতো হাজারো শ্রমিক এখন বাড়িতে থেকে কাজ করছে।
কোচাশহর এলাকার কারখানা মালিক রবিউল হোসেন বলেন, আমাদের এলাকায় প্রত্যেক বাড়িতে এখন ছোট-বড় কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। পরিবারের সবাই এসব কারখানায় কাজ করে। স্বল্প মূল্যে শ্রমিক পাওয়ায় এবং বাড়িতে থেকেই সব পোশাক বিক্রি হওয়ায় অনেক লাভ হয়।
হোসিয়ারি শিল্পের কারণে এলাকায় কোনো বেকার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এসব কারখানায় উৎপাদিত পণ্য বিক্রিকে কেন্দ্র করে বিশাল এলাকা জুড়ে কয়েক শত পাইকারি দোকান নিয়ে গড়ে উঠেছে নয়ারহাট পাইকারি শীতের কাপড়ের বাজার।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, কেরানীগঞ্জ, রংপুর, বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট, বগুড়া, সৈয়দপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা প্রতিদিন শীতের কাপড় ক্রয় করতে আসছেন।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার বেচাকেনা হলেও এখানে কোনো ব্যাংকের শাখা ও রাস্তাঘাটের উন্নয়ন নেই। ফলে ব্যবসায় সমস্যা হচ্ছে।
নয়ারহাট এলাকার ব্যবসায়ী সোহেল মিয়া বলেন, হোসিয়ারি শিল্পের বিপ্লব ঘটলেও এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়নি। অনেক কষ্ট করে তাদের শিল্পের কাঁচামাল আনতে হয়।
দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা এখানে আসেন। ব্যাংকের শাখা না থাকায় প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার লেনদেন নিয়ে তারা সমস্যায় পড়েন।
গাইবান্ধা বিসিকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক আব্দুল্লাহ আল ফেরদৌস বলেন, হোসিয়ারি শিল্প সম্প্রসারণে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়া হচ্ছে। হোসিয়ারি শিল্পের কারণে এলাকার মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হয়েছে। প্রতিনিয়ত এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় হোসিয়ারি শিল্পের সম্প্রসারণ হচ্ছে। বেকার সমস্যা নিরসনের পাশাপাশি এলাকার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে গোবিন্দগঞ্জের হোসিয়ারি পল্লী।
তিনি আরও বলেন, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় প্রায় ৫ হাজার হোসিয়ারি কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় প্রতি শীত মৌসুমে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার শীতবস্ত্র বেচা-কেনা হয়।
সাননিউজ/আরআরপি