মতামত

আমরা এখন একা

পুরো করোনার সময় একটা বাসার চার দেয়ালের ভেতরে আটকা থেকে সময় কাটিয়েছি। তখন বসে বসে নানা কিছু চিন্তা করেছি, তার মাঝে একটা ছিল করোনার উপদ্রব শেষ হওয়ার পর কী করবো তার নানারকম পরিকল্পনা।

সবচেয়ে বড় কল্পনাটা ছিল রাজশাহী গিয়ে হাসান আজীজুল হক স্যারের সঙ্গে দেখা করে কিছুক্ষণ কথা বলে আসা। স্যারের সঙ্গে অনেকবার দেখা হয়েছে, অনেকবার কথা হয়েছে, কিন্তু আর কেউ নেই শুধু আমি আর স্যার, তার সঙ্গে বসে সাহিত্য, দেশ, ইতিহাস, রাজনীতি এসব সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা বলার একটা ছেলেমানুষী শখ ছিল। যত সময় গেছে সেটা নিয়ে আমার সেই শখটা অনেক বেড়ে গিয়েছিল।

খবর পেয়েছিলাম স্যারের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। তার ছেলের বক্তব্য থেকে জানতে পেরেছিলাম, স্যারের স্মৃতিশক্তিও কমে আসছে, অনেক সময় পরিচিত মানুষকে চিনতে পারেন না। তারপর দেখলাম স্যারকে চিকিৎসার জন্যে ঢাকা নিয়ে আসা হয়েছে, খুব ভয় পেয়েছিলাম তখন। তাঁর ছেলের কাছে স্যারের খোঁজ নিয়েছি। করোনার সময়টিতে আমরা আইসিইউ নামে একটা ভয়ংকর শব্দ শিখেছি, দেখে আসছি একবার কেউ তার ভেতরে গেলে প্রায় কখনোই বেঁচে ফিরে আসছেন না। স্যার কিন্তু সুস্থ হয়ে বের হয়ে এসেছেন, আবার রাজশাহী ফিরে গেছেন দেখে অনেক শান্তি পেয়েছিলাম। শুধু তা-ই না, কয়েক সপ্তাহ আগে দেখলাম স্যার পত্রিকায় একটি লেখা দিয়েছেন, লেখার বিষয়বস্তু আমাকে যতটুকু আনন্দ দিয়েছে তার থেকে বেশি আনন্দ দিয়েছে স্যার আবার লিখছেন সেই তথ্যটুকু।

আমি যখন রাজশাহী যাওয়ার কথা চিন্তা করছি তখন একেবারে হঠাৎ জানতে পারলাম স্যার আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। হঠাৎ মনে হলো একেবারে একা হয়ে গেছি। আমাদের বুঝি দেখে-শুনে রাখার আর কেউ নেই।

বহুকাল আগে একবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছি। তখন সময়টা ভালো না, দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, বঙ্গবন্ধুর অবদান এসব কিছুকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে। সেই দুঃসময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ছেলেমেয়েরা মিলে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ভালোবাসাটুকু ধরে রাখার জন্য একটা সংগঠন করেছে। সেই বাচ্চা ছেলেমেয়েরা আমাকে ডেকেছে, আমি তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছি। হঠাৎ দেখি সেই বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মাঝে একজন বড় মানুষ—খবর পেয়ে হাসান আজীজুল হক স্যার চলে এসেছেন। দেশের বাইরে ছিলাম বলে দেশের এই বড় বড় কবি, সাহিত্যিক শিল্পীদের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, তার ওপর সবাই ঢাকাকেন্দ্রিক, শুধু স্যার রাজশাহী থাকেন! স্যারের সঙ্গে পরিচয় হলো, কথা হলো। তারপর থেকে যতবার রাজশাহী গেছি, স্যারের সঙ্গে একটিবার হলেও দেখা করে এসেছি, স্যার হাসিমুখে আমার যন্ত্রণা সহ্য করেছেন।

আমি সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে, অভ্যাস অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথাবার্তা বলে জামাত শিবিরের চক্ষুশূল হয়ে আছি। দুদিন পরপরই আমাকে নিয়ে ঝামেলা হয়, কখনও বাসায় বোমা পড়ে, কখনও ফাঁসির দাবি, কখনও আমার বিরুদ্ধে আন্দোলন— স্যার প্রতিবার রাজশাহী থেকে আমাকে ফোন করেন, সাহস দেন। আমার পাশে আছেন বলে আমিও ভরসা পাই, বাড়াবাড়ি করছি কিনা জানি না, কিন্তু ভুল করছি না সেই বিষয়টা বুঝতে পারি।

এই দেশে যারা থেকেছে, মুক্তিযুদ্ধের জন্য ভালোবাসাটুকু ধরে রাখার জন্য তাদের কাজ করতে হয়েছে, সেজন্য ঝামেলাও কম হয়নি। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়ার পরও স্যারের পরিচয় শুধু অধ্যাপক নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল চেতনার একজন অভিভাবকও। এত কিছুর পরেও স্যারের সবচেয়ে বড় পরিচয় হচ্ছে লেখক। আমি নিজে আমার ছেলেমানুষী লেখার চেষ্টা করি বলে বুঝতে পারি আমরা কেন দায়সারা লেখক আর স্যার কেন সত্যিকারের লেখক। শুধু লেখক নয়, বড় লেখক! খুব বেশি লিখেননি কিন্তু যেটুকু লিখেছেন একেবারে খাঁটি সোনা। দেখে ভালো লাগে যে, স্যারের লেখার জন্য দেশে এবং দেশের বাইরে ঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে।

বহুদিন আগে এলিস ওয়াকারের লেখা ‘দি কালার পারপল’ নামে একটা উপন্যাস পড়েছিলাম (আমার ধারণা এই নামে তৈরি চলচ্চিত্রটি মূল বই থেকে বেশি পরিচিত)। যারা মূল বইটি পড়েছেন তারা জানেন এই বইয়ের ভাষা কিন্তু আমাদের পরিচিত ইংরেজি নয়, আমেরিকান কালো মানুষদের নিজস্ব এক ধরনের ভাষা। প্রথম এক দুই পৃষ্ঠা পড়লেই এই ভাষাটিতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া যায়, তখন এই নতুন ভাষাটিকে রীতিমতো মিষ্টি একটি ভাষা বলে মনে হতে থাকে। আমাদের বাংলা ভাষায় লেখা বইয়েও কেউ এক দুটি সংলাপ নয়, পুরো বইটি এভাবে লিখেছেন কিনা আমার সেটি নিয়ে কৌতূহল ছিল।

হাসান আজীজুল হক স্যারের আগুনপাখী বইটি পড়ে আমার সেই অতৃপ্তিটুকু প্রথমবার পূরণ হয়েছে। প্রমিত ভাষায় বই পড়ে পড়ে হঠাৎ একটা স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় একটা মেয়ের জবানিতে পুরো বইটুকু পড়ে মনে হয় সামনে বুঝি একটা নতুন দিগন্ত খুলে গেছে। বইয়ের ভাষা হচ্ছে মাত্র একটি দিক, বইটিতে সেই সময়ের এত নিখুঁত এবং এত মানবিক একটি ইতিহাস উঠে এসেছে যে তার তুলনা নেই। ব্রিটিশ উপনিবেশ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, আমাদের দেশে যে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করেছিল তার একটা অসাধারণ বাস্তব ছবি এই বইয়ে পরম মমতায় তুলে ধরা হয়েছে, সেটি না পড়া পর্যন্ত কেউ বুঝতে পারবে না। স্যারের সঙ্গে যতবার দেখা হয়েছে প্রত্যেকবার সাধারণ কথাবার্তা হয়েছে কিন্তু আমার মনের গহিনে একজন সত্যিকার সাহিত্যিকের সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে কথা বলার একটা গোপন বাসনা ছিল। সেই বাসনাটুকু বাসনা হিসেবেই থেকে গেলো।

হাসান আজীজুল হক স্যারের মেধাবী ছেলেটি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছিল। সে যোগ্য প্রার্থী ছিল, এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কিন্তু সেই সময়টিতে হাসান আজীজুল হকের পুত্র হওয়ার অপরাধে এখানে নিয়োগ পায়নি, যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে তার মতো একজনের খুবই প্রয়োজন ছিল। তখন তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল এবং তার কাছে স্যারের অনেক গল্প শুনেছি। তার কাছে জেনেছি স্যারের হাতের লেখা নাকি খুবই দুর্বোধ্য, যারা তাঁর হাতের লেখার সঙ্গে পরিচিত নন তাদের কাছে মনে হবে স্যার বুঝি কলম দিয়ে কাগজে দাগ দিয়ে গেছেন, মাঝে মাঝে শুধু কলমটি একটু উপরে নিচে করেছেন! শুধু সে তার হাতের লেখা মর্মোদ্ধার করতে পারে! আমি স্যারের হাতের লেখা দেখিনি, তাই কথাটুকু কতটুকু বাবাকে নিয়ে কৌতুক কতটুকু সত্যি কখনও যাচাই করে দেখতে পারিনি! হাতের লেখা যেরকমই হয়ে থাকুক, সেই লেখা দিয়ে তিনি যে অসাধারণ লেখাগুলো লিখে গিয়েছেন তার জন্য আমরা সবসময়েই স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো।

আমি জানি, স্যার পরিণত বয়সে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন শেষে অসাধারণ কালজয়ী কিছু লেখা আমাদের উপহার দিয়ে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে থেকে দেশের অসংখ্য মানুষের অভিভাবক হয়ে আত্মীয়-পরিজন-গুণগ্রাহীদের মাঝে থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমাদের হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলে এটা মেনেই নিতে হবে।

কিন্তু যখন মনে হয় তিনি আর নেই, তখনই মনে হয় এখন আমরা একা। একেবারেই একা।

লেখক: মুহম্মদ জাফর ইকবাল, শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক

সাননিউজ/জেআই

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

ঘূর্ণিঝড় নিয়ে যা জানাল আবহাওয়া অধিদপ্তর

আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি...

লুটপাটের ভিডিও করায় সাংবাদিককে হেনস্তা 

লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য নুর উদ্দিন চৌধ...

নিহত যুবদল নেতার পরিবারের পাশে তারেক রহমান

বগুড়ায় সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত যুবদল নেতা রাহুল সরকারের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়...

ফিলিস্তিনের জলসীমায় ইসরায়েলের কোনো কর্তৃত্ব নেই

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার ওপর ইসরায়েলের 'আক্রমণ ও আগ্রাসনের' নিন্দা জা...

দুর্ব্যবহারের কারণে এনসিপির সংবাদ সম্মেলন বর্জন

রাজধানী ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে দুর্ব্য...

শাপলা নয় এনসিপিকে বালতি-বেগুনসহ ৫০ প্রতীকের অপশন

শাপলা প্রতীক নয় বরং বেগুন, বালতিসহ ৫০টি প্রতীক থেকে জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এন...

২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরও ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৩৯৬

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২৪ ঘণ্টায় আরও দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর এইডস ম...

আ. লীগের ঘাপটি মেরে থাকা অনুচরেরা এখনো তৎপর

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজ...

লুটপাটের ভিডিও করায় সাংবাদিককে হেনস্তা 

লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য নুর উদ্দিন চৌধ...

গাজাগামী ত্রাণবাহী জাহাজ আটক, নিরাপত্তার দাবি জামায়াতের

গাজামুখী ত্রাণবাহী জাহাজ আটক করার ঘটনায় ইসরায়েলের ন্যাক্কারজনক ভূমিকার তীব্র...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা