ছবি: সংগৃহীত
নারী

সুঁই-সুতোয় তাসলিমার রঙিন দিন

গাইবান্ধা প্রতিনিধি: এনজিওর কাছ থেকে মাত্র ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে কিছু কাপড় ও সুতা কেনেন। এরপর ২০১৭ সালে নিজের আঁকা ডিজাইনের কয়েকটি থ্রিপিস সুঁই-সুতোয় হ্যান্ড এমব্রয়ডারি করেন। হ্যান্ড এমব্রয়ডারি পণ্যগুলোর ছবি তুলে নিজের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করেন।

আরও পড়ুন: কৃষকের আঙিনায় ভুট্টার সোনা রাঙা হাসি

পরিচিতজনদের কাছে ভালোই সাড়া পান। তখনও ব্যবসা উদ্যোগটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়নি। ২০১৯ সালে একটি ফেসবুক পেজ খুলে নিজের আঁকা ডিজাইনের হ্যান্ড এমব্রয়ডারি পণ্যগুলো নিয়ে ফাতিহা হ্যান্ডিক্রাফট নামে অনলাইনে সরব হয়ে ওঠেন। তখন থেকে শুরু হয় সুঁই-সুতোয় তাসলিমা আজম লিজার রঙিন দিন।

ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকির ঝোঁক ছিল তার। খাতায় তিনি আঁকতেন সেই চিরচেনা গ্রামের দৃশ্য কুঁড়েঘর, তার পেছনে কলাগাছ আর নদী-মাছ, ফুল-পাখি।

ইউটিউব আর টেলিভিশন দেখে শখের বসে কাপড়ে নিজের আঁকায় নকশি তোলার কাজ শিখেছিলেন।

কে জানত এটিই তার উপার্জনের মাধ্যম হয়ে উঠবে। তিনি হয়ে উঠবেন একজন উদ্যোক্তা, যার মাসে আয় লক্ষাধিক টাকা। তিনি লড়াকু এক যোদ্ধা। যিনি নানা ঘাত-প্রতিঘাত জয় করেন, সমাজের বাধা-বিপত্তি ঠেলে জয়ের মশাল জ্বালিয়েছেন।

আরও পড়ুন: ছুটির দিনে মুখর সোহরাওয়ার্দী

গাইবান্ধা জেলা শহরের ব্রিজ রোডে মডার্ণ হাই স্কুলের বিপরীতে তার বাড়ি। সেখানে গড়েছেন রকমারি হস্তশিল্পের প্রতিষ্ঠান।

বর্তমানে তাসলিমা আজমের প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের নান্দনিক ডিজাইনের ফ্যাশনেবল হাতে তৈরি শাড়ি, থ্রিপিস, ওয়ান পিস, পাঞ্জাবি, শাল, শিশুদের পোশাক, নকশিকাঁথা, ওয়ালমেট ও কুশন কাভার ইত্যাদি সামগ্রী প্রস্তুত করছে।

যাত্রাটা ফেসবুক পেজ থেকে শুরু হলেও এখন তার রয়েছে নিজস্ব বিক্রয় কেন্দ্র। তার প্রতিষ্ঠানের জন্য সেলাইয়ের কাজ করছে ২ শতাধিক কর্মী। পাশাপাশি স্থায়ীভাবে ৫ জন কর্মী ছাড়াও স্কুল-কলেজের আরও শতাধিক শিক্ষার্থী খন্ডকালীন কর্মী হিসেবে কাজ করে লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছে।

ফাতিহা হ্যান্ডিক্রাফট এখন অনেক সমৃদ্ধ। সেবা গ্রহণকারীরাই তাসলিমার প্রতিষ্ঠানের প্রাণ। তারাই ফাতিহা হ্যান্ডিক্রাফটকে সবার সামনে তুলে ধরেছেন। এটিই তাসলিমার বড় অর্জন।

আরও পড়ুন: শিক্ষকতা ছেড়ে সফল উদ্যোক্তা রেজবিন

তবে শুরুতে প্রতিবন্ধকতাও কম ছিল না। সৃজনশীল কিছু করার তাগিদে হস্তশিল্প পণ্যের ব্যবসা শুরু করেন তিনি। শ্বশুরবাড়ির যৌথ পরিবারে থেকে নতুন একটি ব্যবসা শুরু করতে প্রথমে একটু ধাক্কা সামলাতে হয়েছে।

নারীদের বাইরে কাজের ক্ষেত্রে পারিবারিক যে প্রতিবন্ধকতা থাকে, তেমনটি তারও ছিল। তবে শুরুতে প্রধান সমস্যাটা ছিল অর্থনৈতিক। এছাড়া সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও খুব একটা নারীবান্ধব ছিল না। এগুলোকে মোকাবিলা করেই হয়তো এ পর্যায়ে আসা সম্ভব হয়েছে।

তবে কয়েক দিন পর ব্যবসার সফলতা দেখে পরিবারও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। ২০১২ সালে গাইবান্ধা সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন তাসলিমা। ওই বছরই নিজের পছন্দের মানুষ শাহরিয়ার সাগরকে সঙ্গে নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন।

আরও পড়ুন: দুঃখের চরে মিষ্টি আলু, কৃষকের মুখে হাসি

সাগর ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে এবং তিনি নিজেও একজন ব্যবসায়ী। বিয়ের পর তাসলিমা জেলা শহরের চকমামরোজপুরে বাবার বাড়ি ছেড়ে ব্রিজ রোডে শ্বশুরবাড়িতে চলে আসে।

সেখানে শাশুড়ি, দুই ভাশুর-জা আর ননদের যৌথ পরিবারে বর সাগরের সঙ্গে নিজের সংসার গড়ে তোলেন। এখন সাগর-তাসলিমা দম্পতির ঘর আলো করে বেড়ে উঠছে তাদের ২ সন্তান। পুত্র তাহমিদ আবরার ছোয়াদ চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে আর কন্যা ফাতিহা সাফা প্রাক-প্রাথমিকে।

শ্বশুরবাড়ি থেকেই তাসলিমা বিএসএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাসলিমার বাবা গোলাম আজম অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য, মা লাকী আজম গৃহিণী। তাদের ২ কন্যা সন্তানের মধ্যে তাসলিমা বড়।

তাসলিমার হাতের কাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্বকীয়তা। আঁকার প্রতি ভালো লাগা থেকেই মূলত শুরু হয় ফাতিহা হ্যান্ডিক্রাফটের যাত্রা। সম্পূর্ণ দেশি কাঁচামালে তৈরি হস্তশিল্প পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান তার।

আরও পড়ুন: গাইবান্ধায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে সূর্যমুখী

কাপড় সংগ্রহ, সুতা, রং ও নকশা নির্ধারণ এবং সমসাময়িক ধারা অনুসরণ করে পণ্য তৈরি করাসহ যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় দেশি কাঁচামালে।

যখন নিজের দেশের কাঁচামাল, স্থানীয় নারী সুচিশিল্পী-কারিগর দিয়েই তৈরি হয়, তখনই আত্মতৃপ্তি অনেকগুণ বেড়ে যায় তাসলিমার।

দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা শহরে হস্তশিল্প মেলায় অংশ নেয়া তাসলিমা বলেন, মূলত মেলায় বেচা-কেনা তেমন একটা না হলেও মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক তৈরি হয়। মেলায় অনেক ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে।

পরবর্তীতে দেখা গেছে, তারাই আমার বড় ক্লায়েন্ট হয়েছে। মেলা ও ফেসবুকের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও নেপালসহ বিভিন্ন দেশের নারীদের সঙ্গে পরিচয় হয় তাসলিমার।

আরও পড়ুন: অস্তিত্ব সংকটে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা-সংস্কৃতি

সেসব দেশের নারীরা তার কাছ থেকে শাড়ি, শাল, নকশিকাঁথা নিয়ে অনেকেই নিজেদের ব্যবসা-উদ্যোগ গড়ে তুলেছেন। অনলাইনে পরিচিত দেশে-বিদেশে অনেকের কাছে পণ্য পাঠান। তাদের সঙ্গে লেনদেনও ভালো।

মূলত বছরের ২ ঈদ, পহেলা বৈশাখ আর শীতকে টার্গেট করেই সারা বছর পণ্য উৎপাদন করে তাসলিমার প্রতিষ্ঠান। হস্তশিল্পের ব্যবসায় নেমে উদ্যোক্তা তাসলিমা আজম লিজা বেশ কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছেন। সবশেষ গাইবান্ধায় উদ্যোক্তা মেলায় জেলা পর্যায়ে সেরা নারী উদ্যোক্তা-২০২১ হিসেবে সম্মানিত হন।

এর আগে ২০২০ সালে সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে অনলাইনভিত্তিক নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করা দেশের শীর্ষ স্থানীয় সংগঠন উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স (উই) ট্রাস্টের লাখপতি অ্যাওয়ার্ড পান তিনি। এছাড়া এসএমইসহ অন্তত ১২টি পুরস্কার রয়েছে তার ঝুলিতে।

তাসলিমা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণ উন্নয়ন কেন্দ্রের (জিইউকে) প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। পাশাপাশি তিনি জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি, বাংলাদেশ (নাসিব) গাইবান্ধা জেলা কমিটির সদস্য সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।

আরও পড়ুন: প্রবেশ মূল্য ২০ টাকা, ফুল ছিঁড়লে ৫০০ টাকা জরিমানা!

তাসলিমা বলেন, বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রধান বাধা হলো আমাদের সংস্কৃতি। যেখানে আমরা নারীকে ঘরকন্যার একটি নির্দিষ্ট ভূমিকায় দেখতে অভ্যস্ত। বাস্তবতায় পারিবারিক দায়িত্ববোধের সঙ্গে একজন নারী তার সত্তাকে সমাজে সফলভাবে পরিচিত করে তুলতে সক্ষম। ঘরে-বাইরে নারীরা আত্মনির্ভরতা চান।

অনলাইনভিত্তিক উদ্যোগগুলোকে অনেকেই সংসার সামলে অবসরে করা শখের কাজ ভাবেন। অনেকে ব্যবসাটি ঘরকেন্দ্রিক ভেবে ব্যবসা-উদ্যোগটির ন্যায্য স্বীকৃতি দেন না। যেকোনো পেশাজীবীর চেয়ে একজন উদ্যোক্তাকে তার ব্যবসায় ভাবনা, শ্রম ও সময় কোনো অংশেই কম দিতে হয় না।

ব্যবসায় পারিবারিক ও সামাজিক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ছাড়াও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রযুক্তিগত জ্ঞান। এসব বিষয়ে দক্ষতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা সফল নারী উদ্যোক্তা হওয়ার অন্যতম শর্ত।

সান নিউজ/এনজে

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

প্রস্তুতি ম্যাচের সূচি প্রকাশ

স্পোর্টস ডেস্ক : আসন্ন আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল আস...

টিভিতে আজকের খেলা

স্পোর্টস ডেস্ক: প্রতিদিনের মতো আজ শনিবার (১৮মে) বেশ কিছু খেল...

কর্মস্থলে না এসেও বেতন তোলেন শিক্ষক

আবু রাসেল সুমন, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি:

মেঘনা নদীতে পাঙ্গাশ রক্ষায় অবৈধ চাই ধ্বংস 

ভোলা প্রতিনিধি: ভোলায় মেঘনা নদী থ...

মুন্সীগঞ্জে ভাসমান মরদেহ উদ্ধার

মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ : মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার মধ্য কোটগাঁ...

ওএমএস বিতরণে গাফলতি হলে ব্যবস্থা

নিজস্ব প্রতিবেদক: খাদ্যমন্ত্রী সা...

পটল কেন উপকারী?

লাইফস্টাইল ডেস্ক: পটল আমাদের দেশের পরিচিত একটি সবজি, যা খেতে...

মিডিয়া ট্রায়াল বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে

জেলা প্রতিনিধি: বিচারের আগে মিডিয...

হোয়াটসঅ্যাপে আসছে পরিবর্তন

টেকলাইফ ডেস্ক: জনপ্রিয় যোগাযোগ মা...

মঙ্গলবার ১৫৭ উপজেলায় সাধারণ ছুটি 

নিজস্ব প্রতিবেদক: ষষ্ঠ উপজেলা পরি...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা