জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধানসংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে চারটির বেশি প্রশ্ন নিয়ে গণভোট আয়োজনের চিন্তা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এই গণভোটে এমন প্রশ্নগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে, যেগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য ও মতভেদ দুই-ই আছে। উদ্দেশ্য হলো—সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবগুলোর ওপর জনগণের প্রত্যক্ষ মতামত নেওয়া এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক ম্যান্ডেট নিশ্চিত করা।
সূত্র জানায়, বিএনপি–জামায়াতসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল যেসব প্রস্তাবে একমত, সেগুলো নিয়ে একটি সাধারণ প্রশ্ন রাখা হবে। আর সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এবং ন্যায়পাল বা সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগপদ্ধতির মতো যেসব ইস্যুতে বড় দলগুলোর মতবিরোধ রয়েছে, সেগুলো নিয়ে আলাদা প্রশ্ন রাখা হবে। সব মিলিয়ে গণভোটে চার থেকে পাঁচটি প্রশ্ন থাকতে পারে।
সরকার একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং গণভোট আয়োজনের পরিকল্পনা করছে। সরকারের ধারণা, একই দিনে ভোট হলে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। এভাবে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে বিএনপি–জামায়াতসহ বেশিরভাগ দল গণভোটে অংশ নিতে আগ্রহী হবে বলেই আশা করা হচ্ছে।
আসিফ নজরুলের বক্তব্য
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল মঙ্গলবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বলেন, “সনদ বাস্তবায়নের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, তা তিন–চার দিনের মধ্যেই পরিষ্কারভাবে জানতে পারবেন।” তিনি জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঐক্য আনার চেষ্টা চলছে, তবে সরকার বসে নেই—নিজেদের উদ্যোগেও কাজ এগিয়ে নিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, “সব দলের প্রত্যাশার প্রতি সম্মান রেখেই জনগণের স্বার্থে যা প্রয়োজন, সেটাই করা হবে।” তিনি অভিযোগ করেন, “ঐকমত্য কমিশনের কাজকে ঘিরে নানা ধরনের অপপ্রচার চলছে। কমিশনের আলোচনা ও প্রস্তাবগুলোকে পণ্ডশ্রম বলা ঠিক নয়। সংস্কার বাস্তবায়নে আমলাতান্ত্রিক প্রতিরোধও বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”
পুলিশ সংস্কার কমিশনের উদাহরণ টেনে আইন উপদেষ্টা বলেন, “আইজিপি নিয়োগের ক্ষেত্রে কমিশনের প্রস্তাব ছিল—তিনজন প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করা হবে, এবং সরকার তাঁদের মধ্য থেকে একজনকে নিয়োগ দেবে। কিন্তু আন্তমন্ত্রণালয় পর্যায়ে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা হয়েছে।”
গণভোটে সম্ভাব্য প্রশ্নসমূহ
সরকারি সূত্র বলছে, সংবিধানসংক্রান্ত ৪৮টি প্রস্তাবের মধ্যে প্রায় ৩০টি প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য রয়েছে। সেগুলো নিয়ে প্রথম প্রশ্নে ভোটারদের মত নেওয়া হবে—তারা এই ৩০টি সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন চান কি না।
বাকি ১৮টি প্রস্তাবে বড় দলগুলোর ভিন্নমত আছে। সেগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে:
সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি চালু করা হবে কি না।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনরায় চালু করা হবে কি না।
ন্যায়পাল, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, সিএজি ও দুর্নীতি দমন কমিশনে স্বচ্ছ নিয়োগব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে কি না।
পটভূমি
৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ছয়টি সংস্কার কমিশনের ৮৪টি প্রস্তাব নিয়ে তৈরি করা হয় জুলাই জাতীয় সনদ। এর মধ্যে ৪৮টি প্রস্তাব সংবিধানসংক্রান্ত। কিন্তু অন্তত ৩০টি প্রস্তাবে এক বা একাধিক দলের ভিন্নমত রয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একটি প্রশ্নেই গণভোটের সুপারিশ করেছিল—যাতে ভোটাররা পুরো সংস্কার সনদকে সমর্থন বা অসমর্থন জানাতে পারবেন। কিন্তু বিএনপি ও জামায়াতসহ কয়েকটি দল একাধিক প্রশ্ন রাখার দাবি তোলে, যাতে বিতর্কিত ইস্যুগুলো আলাদা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।
গণভোটের পর করণীয়
ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, সরকার প্রথমে “জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ” জারি করবে। এরপর ওই আদেশ ও ৪৮টি প্রস্তাব নিয়ে গণভোট হবে। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়ী হলে পরবর্তী সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে এবং ২৭০ দিনের মধ্যে সংশোধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে। যদি সংসদ এ সময়ের মধ্যে ব্যর্থ হয়, তাহলে প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে।
সব মিলিয়ে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে আয়োজনের প্রস্তুতি সরকারকে শুধু রাজনৈতিক সমঝোতার পরীক্ষায়ই ফেলছে না, বরং সংবিধান সংস্কারের নতুন এক অধ্যায় শুরু করার চ্যালেঞ্জের মুখেও দাঁড় করাচ্ছে।
সাননিউজ/এও