বিনয় দত্ত: ‘বাংলাদেশ বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ: শিক্ষামন্ত্রী’। গত ২০ জুলাই শিক্ষামন্ত্রীর এই উক্তি গণমাধ্যমে এসেছে। তিনি কোন যুক্তিতে এ কথা বলেছেন আমার জানা নেই। কারণ বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে।
আরও পড়ুন: স্তালিনের পথে হাঁটছেন পুতিন
‘বিদ্যুৎ ঘাটতি আরও ভোগাতে পারে’, ‘প্রথম দিনেই রুটিন ভেঙে লোডশেডিং’, ‘এক ঘণ্টার লোডশেডিং কোথাও সাত ঘণ্টা’- এ সবই সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি সংবাদ শিরোনাম। তবে এ কথা ঠিক, বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়ন হয়েছে। গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ সেবা পৌঁছানোর লক্ষ্যে সরকারের আন্তরিকতারও কোনো কমতি নেই। সংকট আসলে ভবিষ্যৎ নিয়ে।
আমাদের দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে কাঁচামাল তা আসে বিদেশ থেকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ গোটা বিশ্বকে যেমন বিপদে ফেলেছে, সেই প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। একদিকে যেমন কাঁচামালের ঘাটতি দেখা দিয়েছে, আরেক দিকে বিদ্যুৎ নিয়ে আসলে আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছিল না। তারপরও আমরা একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে মগ্ন ছিলাম। বিদ্যুতের যে কাঁচামাল তা কোথা থেকে আসবে তা নিয়ে আর ভাবিনি। এমনকি অতিরিক্ত বিদ্যুৎ দিয়ে আমরা কী করবো তারও কোনো সঠিক পরিকল্পনা ছিল না। এই তথ্য আমরা পাই গত ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সালে ‘প্রথম আলো’ প্রত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতেবেদনে।
আরও পড়ুন: গবেষণা হোক মানবমুক্তির হাতিয়ার
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী: ‘নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনাও (পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান) মানা হচ্ছে না। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩১ সালে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা গিয়ে দাঁড়াবে ৩৭ হাজার মেগাওয়াট। এই সময় বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা থাকবে ২৯ হাজার মেগাওয়াট। মোট ক্ষমতার ২০ থেকে ২৫ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রাখা যাবে না। বর্তমানে সেখানে অলস বসে আছে প্রায় ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র।’
এবার আসি আসল কথায়। ২০১৯ সালে যা ভাবা হয়েছিল তার ধারে কাছেই আমরা নেই। অর্থাৎ যেখানে ২০৩১ সালে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা গিয়ে দাঁড়াবে ৩৭ হাজার মেগাওয়াট বলা হয়েছিল, সেই জায়গায় আমরা ২০২২ সালেই এসে বিদ্যুতের মহাসংকটে পড়েছি। এতে দুটি বিষয় প্রমাণিত। একে তো গ্রাহক সেবা এবং নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের দৌড়ে অন্যান্য সংকটগুলোর আমরা ভাবিনি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। অপরিকল্পিত বিদ্যুৎকেন্দ্র যেমন কোনো কাজে দেয়নি তেমনি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র করার প্রতিযোগিতায় আমরা বিদ্যুতের কাঁচামালের কথা ভাবিনি বা কাঁচামাল সরবরাহ না থাকলে কী হবে তাও ভাবিনি বা অন্য কোনো পথ থাকলেও তাও অবহেলা করেছি। কারণ তাতে ব্যক্তিস্বার্থ নেই। তাতে প্রকল্প অনুমোদন নেই। অর্থের লেনদেন নেই। লাভ নেই।
আরও পড়ুন: পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
বিশ্ব যখন সৌরবিদ্যুৎ বা সোলার প্যানেলে ঝুঁকছিল তখন আমরা সেই পথে হাঁটিনি। আমার এখনো মনে আছে, প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক যখন জীবিত ছিলেন, তখন প্রত্যেক নির্মাণাধীন বাড়ি অনুমোদনের ক্ষেত্রে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য জোর দাবি জানিয়েছেন। যাতে সংরক্ষিত বৃষ্টির পানি পরবর্তীতে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু তা আর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। একই প্রক্রিয়ায় সৌরবিদ্যুৎ বা সোলার প্যানেল ব্যবহারে আমাদের যে পরিমাণ মনোযোগী হওয়ার দরকার ছিল আমরা হইনি।
আবাসিক, অনাবাসিক, শিল্পকারখানা থেকে শুরু করে সব জায়গায় যদি সৌরবিদ্যুৎ বা সোলার প্যানেলের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা যেত তাহলে উৎপাদিত বিদ্যুতের ওপর চাপ কমতো। শুধু তাই নয়, এতে করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাড়তি খরচ কমতো এবং বিদ্যুৎ নিয়ে এই ভয়াবহ সংকট কিছুটা লাঘব করা যেত। আমরা সেই পথে হাঁটিনি।
রাজধানীর বেশিরভাগ সোলার প্যানেল অকার্যকর (চ্যানেল টোয়ান্টিফোর, ২১ জুলাই ২০২২)। এতেই প্রমাণিত হয় আমরা আসলে পরিকল্পনা করলে তা বাস্তবায়নে জোর দেই না। বিদ্যুৎখেকো ১৫ লাখ ইজিবাইক দৈনিক দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ, বেশির ভাগ গ্যারেজেই অবৈধ সংযোগে রাতভর চার্জ হচ্ছে ব্যাটারি (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২১ জুলাই ২০২২)। সারাদেশে ১৫ লাখ ইজিবাইক কী পরিমাণ বিদ্যুৎ অপচয় করছে তার হিসাব নেই। অথচ এই বিদ্যুৎচালিত যানবাহনকে বৈধতা দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। এ থেকেই বোঝা যায়, এসব পরিকল্পনা আসলে ভবিষ্যৎ ভেবে নেওয়া হয়নি। শুধু পকেট ভারী করার জন্য করা হয়েছিল। এখন তা বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আরও পড়ুন: পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
এখন বিদ্যুতের যে সংকট তাতে বিদ্যুতের অপচয় বন্ধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে আরও ঘোর সংকট আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সেই সংকট সামাল দেওয়ার মতো সক্ষমতা আমাদের আদৌ আছে কিনা সন্দেহ। এ জন্য কিছু উদ্যোগ এখনই নিতে হবে। যত ধরনের ভবন নির্মাণ করা হবে সবগুলোতে সোলার প্যানেল বাধ্যতামূলক করে তা কার্যকর হচ্ছে কিনা তাও সরেজমিনে দেখতে হবে। পুরোনো প্রত্যেক ভবনে সোলার প্যানেল স্থাপন বাধ্যতামূলক করতে হবে। যাতে উৎপাদিত বিদ্যুতের ওপর চাম কমে। নতুন-পুরাতন প্রত্যেক ভবনের আশেপাশে গাছ লাগাতে হবে তাতে করে পরিবেশ শীতল থাকবে।
অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন বন্ধ করতে হবে। যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র অব্যবহৃত সেগুলো সচল করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজ লাগাতে হবে। প্রত্যেক বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে বিপণী বিতানগুলোতে বিদ্যুৎ অপচয় বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে সরকারকে এখনই কঠোর ভূমিকায় যেতে হবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক