মতামত

'আমাদের' সাইমন ড্রিংয়ের প্রথম প্রয়াণ বার্ষিকী

হাসান শাওন: অব্যক্তই থাকত হয়তো একাত্তরের পাকিস্তানি নৃশংসতা। যদি না থাকতেন আমাদের একজন সাইমন ড্রিং। খুব অধিকার করেই “আমাদের” ডাকা। সাইমন ড্রিং তো আমাদেরই ছিলেন। কী দরকার ছিল তার বাঙালির জন্য নিজের প্রাণকে ঝুঁকিতে নেওয়ার?

হত্যায় কুশলী পাক সেনাবাহিনী যখন ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ক্র্যাকডাউন শুরুর আগে ঢাকায় থাকা প্রায় অর্ধশত বিদেশি সাংবাদিককে আটকে ফেলে হোটেল ইন্টারকন্টিন্যালে। পরদিন তাদের হোটেল থেকে সরাসরি বিমানে তুলে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তখনো সায়মন ড্রিং ঐ হোটেলেই ছিলেন। পাক আর্মির নির্দেশ অমান্য করে তিনি লুকিয়ে থাকেন। শ্বাসরুদ্ধকর ৩২ ঘণ্টার বেশি সময় তার কাটে হোটেলের লবি, ছাদ, বার, কিচেনের মতো জায়গায়। ২৭ মার্চ কারফিউ ওঠে। সায়মন ড্রিং হোটেলের বাইরে আসেন। দেখতে পান লাশ আর আগুনে পোড়া শহর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকাসহ ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর ঘুরে দেখেন। এরপর নিজের নোটবুক নিয়ে থাইল্যান্ড চলে যান। নির্মমতার সেই প্রত্যক্ষ চিত্র তুলে ধরে ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফে প্রকাশিত হয় সায়মন ড্রিংয়ের প্রতিবেদন “ট্যাংকস ক্রাশ রিভল্ট ইন পাকিস্তান”। সেটি ছিল বিশ্ব গণমাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় পাকিস্তানি গণহত্যার প্রথম প্রকাশ। হানাদারদের মোনাফেকি উন্মোচন করে তিনি লিখেছিলেন, “আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত এক সন্ত্রস্ত নগর।”

আজ ১৬ জুলাই বাংলাদেশের পরম বন্ধু, সাংবাদিক এই সাইমন ড্রিংয়ের প্রথম প্রয়াণ বার্ষিকী। গত বছর অর্থ্যাৎ ২০২১ সালের ১৬ জুলাই রোমানিয়ায় ৭৬ বছর বয়সে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বাংলাদেশ হারায় তার সাথে একাত্ম এক সত্ত্বাকে।

১৯৪৫ সালের ১১ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের নরফোকে জন্মেছিলেন সাইমন ড্রিং। দুরন্তপনার শৈশব ছিল সাইমনের। কঠিন নিয়ম কানুনের বোর্ডিং স্কুলে পড়তেন তিনি। মধ্যরাতে নদীতে সাঁতরাতে ইচ্ছে করে একবার। সে “অপরাধ” এ স্কুল থেকে বহিঃস্কার করা হয় তাকে। পরে অবশ্য পড়েছেন কিংস লিয়ান টেকনিক্যাল কলেজে।

ভিন্ন ধাতে গড়া মানুষ এই সাইমন। দুনিয়া ঘোরার নেশায় ১৯৬২ সালে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়েন। সে সময় তার বয়স মাত্র ১৭ বছর। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ভারতও দেখেন সে বয়সে। তার প্রথম চাকরি ছিল সংবাদপত্র অফিসে প্রুফ রিডারের। জীবনের পাঠশালার শিক্ষাই তাকে সাংবাদিকতায় ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। ১৯৬৩ সালে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ওয়ার্ল্ড সংবাদপত্রে ফিচার রাইটার হিসেবে নিয়োগ পান সাইমন ড্রিং। পরে লাওস থেকে যুক্তরাজ্যের ডেইলি মেইল আর যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক টাইমসের জন্য তিনি ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতে থাকেন।

পৃথিবীর যেখানেই যুদ্ধ, অভ্যুত্থান, বিপ্লব - সেখানেই চষে বেড়িয়েছেন সাইমন ড্রিং। যুদ্ধক্ষেত্রের সংবাদ সংগ্রহে আহতও হয়েছেন একাধিকবার। ১৯৬৪ সালে তিনি সর্বকনিষ্ঠ বৈদেশিক সংবাদদাতা হিসেবে ভিয়েতনাম যুদ্ধ কভার করেন রয়টার্সের হয়ে। সত্তর ও আশির দশকে তিনি ডেইলি টেলিগ্রাফ, বিবিসি টেলিভিশন, বিবিসি রেডিও, সানডে টাইমস, নিউজউইকের হয়ে দায়িত্ব পালন করেন।

ইরানের শাহবিরোধী বিপ্লবের সময় সায়মন ড্রিংয়ের লেখা বিভিন্ন প্রতিবেদন ব্যাপক সাড়া ফেলে। পুরস্কারও পান এজন্য। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের সময় যে বিমানে করে আয়াতুল্লাহ খোমেনি প্যারিস থেকে তেহরানে পৌঁছেছিলেন, সেই একই বিমানে সায়মন ড্রিংও ছিলেন।

সায়মন ড্রিং ছিলেন পৃথিবীর শাসকদের বিরুদ্ধে সত্যের প্রতিলিপিকার সাংবাদিক। উগান্ডায় কাজের সময় তিনি একনায়ক ইদি আমিনের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের হুমকি পান। আফ্রিকার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সহায়তা তহবিল সংগ্রহেও তিনি সক্রিয় ছিলেন।

সায়মন ড্রিংয়ের ভেতর দেখা যায়, নিত্য নতুন ভাবনারত এক সৃষ্টিশীল সাংবাদিক। জরাহীন এক ব্যক্তিত্ব যেন তিনি। ৪৭ বছর বয়সে বিবিসি রেডিও ফোরের “অন দ্য রোড এগেইন” শিরোনামে একটি সিরিজের জন্য তার কৈশোরের দুনিয়া ঘোরার পথ ধরে আবারও বেড়িয়ে পড়েন ১৮ হাজার মাইলের দীর্ঘ ভ্রমণে। পরে ১৯৯৪ সালে সে যাত্রা নিয়ে একই নামের আট পর্বের ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেন, যা বিবিসি টেলিভিশন এবং ডিসকভারিতে প্রচারিত হয়। ১৯৯৫ সালে সাইমন ড্রিংয়ের লেখা “অন দ্য রোড এগেইন: থার্টি ইয়ার্স অন দ্য ট্র্যাভেলার্স ট্রেইল টু ইন্ডিয়া” নামে একটি বই প্রকাশ করে বিবিসি বুকস।

যে কারণে সাইমন ড্রিং “আমাদের” সে পর্বে যাওয়া যেতে পারে। আবার তিনি বাংলাদেশে আসেন ১৯৯৭ সালে। এ দেশের প্রথম বেসরকারি টেরেস্ট্রিয়াল টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টিভি গড়ার প্রধান কারিগর ছিলেন তিনি। বিটিভির বাইরে এক পৃথিবীর সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ পরিচিত হন। বিপুল জনপ্রিয়তা পায় একুশে টিভি। অসংখ্য ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট ও টেকনিশিয়ান তৈরি করেন তিনি এদেশে। ২০০১ সালে একুশে টিভি সম্প্রচার বন্ধ করা হয়। সেসময় সায়মন ড্রিংয়ের ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করা হলে তিনি বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য হন।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা জানানোর উদ্যোগ নেয়। ২০১২ সালের মার্চে আবার বাংলাদেশ পায় সায়মন ড্রিংকে। পরে তিনি কিছুদিন যমুনা টেলিভিশনের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেন।

সাইমন ড্রিংয়ের হাতে গড়া সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণে এখন দেশের মিডিয়া। কিন্তু তারা কতটুকু গুরুর শেখানো পথে হাঁটছেন তার বিবেচক জনগণ। তাদের কাজের মাধ্যমেই “আমাদের” সাইমন ড্রিংকে মনে পড়বে বারবার।

সূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

আড়িয়ল ইউপিতে উপ-নির্বাচন

মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি:

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি দিবস

সান নিউজ ডেস্ক: আজকের ঘটনা কাল অতীত। প্রত্যেকটি অতীত সময়ের স...

ভোলায় ছাত্রলীগের বৃক্ষরোপন কর্মসূচি পালিত 

ভোলা প্রতিনিধি: তীব্র তাপদাহ থেকে...

খাগড়াছড়িতে গৃহকর্মীকে জিম্মির অভিযোগ 

আবু রাসেল সুমন, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধিঃ

কার্বণ মিল ও সীসা কারখানা বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন

কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী প্রতিনিধি:

অনির্দিষ্টকালের জন্য চুয়েট বন্ধ ঘোষণা

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাস চাপায় চুয়েট...

রাজধানীতে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর শাঁখা...

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাড়ছে না ছুটি

নিজস্ব প্রতিবেদক : আবহাওয়া অধিদপ্...

আবারও কমলো স্বর্ণের দাম

নিজস্ব প্রতিবেদক : চলতি মাসে তিন...

রংপুরে বৃষ্টির জন্য ইস্তিসকার নামাজ আদায়

রংপুর প্রতিনিধি : সারাদেশের মতো র...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা