নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশকে নিয়ে অনেক ভাবতো আমার ছেলে। ও বলায় নয় কর্মে বিশ্বাসী ছিল। ছেলে আমাকে বলতো, আম্মা আমরা যদি দেশে ভালো কিছু রেখে যাই তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সেটা অনুসরণ করবে।
সোমবার (১০ আগস্ট) দুপুরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সংবাদ সম্মেলনে কথাগুলো বলছিলেন সদ্য পুলিশের গুলিতে নিহত সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের মা নাসিমা আক্তার।
নাসিমা আক্তার বলেন, 'সিনহা বলত ভালো কাজ দিয়ে যদি মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারি, এর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে। আমি বলতাম, বাবা তুমি যে আর্মি থেকে চলে আসছ, সেখানে এতগুলো কোর্স তাহলে কেন করলে? এখন তোমার কত প্রমোশন হতো, ভালো অবস্থান হতো তোমার। সে বলত মাম্মি, 'পাওয়ার! পাওয়ার কী? পাওয়ার আজ আছে কাল নেই, মানুষে হৃদয়ের মধ্যে থাকব, কাজ করব। আর কাজের কথা মুখে বলার মতো কিছু নয়।'
নাসিমা বলেন, 'কাজের কথা মুখে বলত না সে। আমি বুঝতাম, সে কথায় বিশ্বাসী ছিল না, কাজে বিশ্বাসী ছিল। যেমন বিশ্ব ভ্রমণ করা নিয়ে সে বলত, এটা তো স্বাভাবিক ঘটনা, এইটা নিয়ে কোনো পূর্বপরিকল্পনা নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ সে জানাতে চাইত না। সারপ্রাইজ দেবে। কিছু উপহার দেবে দেশকে। নেক্সট জেনারেশনের কথা অনেক ভাবত। বলত, আমরা যদি কিছু ভালো রেখে যাই পৃথিবীতে। আম্মু এই দেশের সবাই শুধু নেগেটিভ জিনিস দেখে, এই দেশে কিচ্ছু হবে না। কেন? এ ধরনের চরিত্রের অধিকারী সে ছিল।'
'আমি জানতাম, তাঁর চরিত্র এই ধরনের। তাঁর এসব বিষয়ে আমার পূর্ণ সমর্থন ছিল। আমার ছেলের প্রত্যেকটি কর্মকাণ্ডে আমার পূর্ণ সমর্থন ছিল। আমি তাঁকে নিয়ে গর্ববোধ করতাম। ও যেটা করত, আমার মনে হয় আমার চরিত্রের সঙ্গে তাঁর চরিত্রের মিল আছে। আমাদের অন্য কোনো চাহিদা ছিল না। শুধু কাজ করতে চাইত। সেই কাজে আমি কখনো বাধা দিইনি।'
'আমি বলতাম, সবাই বিয়ে-থা করে, তুমি করবে না? সে বলত, ওই সব ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ নেই। কারণ আমি কাজের প্রয়োজনে যেসব জায়গায় যাব, পিছুটান থাকলে সেসব কাজ সঠিকভাবে করা যাবে না। ডকুমেন্টারিটা করতে গেল- এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলত না, ভাসাভাসা বলত, সারপ্রাইজ দিতে চাইত। এমন একটি কাজ করবে, যা ক্রিয়েটিভ কাজ, সবাই সারপ্রাইজড হবে। আমি সারপ্রাইজড হব। আমি বলতাম, তুমি কী কাজ করো; আত্মীয়-স্বজনরা বলত, 'সে কী কাজ করে, কোনো টাকা-পয়সা তো আসে না। ও বলত, আমি আমার মনের খোরাকের জন্য কাজ করি। এটা দিয়ে মানুষ উপকৃত হবে। আমার যেটা ভালো লাগে আমি সেটা করব।' এসব কথা ছেলেকে বললে বলত, 'টাকা-পয়সার কথা আমি ভাবি না।'- এই ছিল তাঁর চরিত্র। আমি বলতাম, 'তুমি যে কাজ করো, কী কাজ করো?' বলত, 'এই যে ডকুমেন্টারি তৈরি করছি।' আমি বলি, 'তুমি তো সেটা বলো না।' বলত, 'এখনো বলার মতো কিছু হয়নি আম্মু। বলার মতো যখন হবে তখন বলব।'
'তবু তাঁর প্রতি আমার আস্থা ছিল শতভাগ। আমি বসে থাকি এই ভেবে যে আমার ছেলে কাজ করছে। সে যা করতে চাইত, আমি তা করতে দিতাম। আমাকে বলত- আম্মু, এই দেশের বাবা-মায়েরা কেমন জানি, খালি সন্তান ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে, আরে তোমাদের জন্য আমরা কেন বলির পাঁঠা হব'- বলেন নাসিমা আক্তার।
'সিনহা আমাকে বলত, আচ্ছা, তোমরা বাবা-মায়েরা লোকের সামনে বলবা- ছেলে ডাক্তার হয়েছে, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। কিন্তু আমার আকাঙ্ক্ষা তো ভিন্ন। আমার সঙ্গে এ নিয়ে প্রায়ই ফান করত। আমি বুঝাতাম, আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবেশ তো আসলে এই রকম। বাইরের দেশের হলে ভিন্ন কথা। সেখানকার অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা- সবই আছে। কিন্তু আমাদের এখানে তো তা নেই। এই কারণে এখানে আমাদের বাবা-মায়েদেরও সন্তানের এসব বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হয়'- তো এই ছিল আমার ছেলের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য।
কথার ভেতর ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন নাসিমা আক্তার। কয়েক মুহূর্তে সামলে নিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মোঁছেন। তারপর আবার বলতে শুরু করেন, 'সিনহা সারা রাত কাজ করতো। এর বাইরে ঘুরতো-ফিরতো, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় যেত। রাতে বাসায় ফিরে নিজেই ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে গরম করে খেতো। খাওয়া শেষে রান্নাঘর পরিষ্কার করে রাখতো- জানতো আমি কিচেন নোংরা করা পছন্দ করি না। এমনভাবে পরিষ্কার করে রাখতো আমি বুঝতেই পারতাম না ও রাতে খেয়েছে। এইভাবে আমি আমার ছেলেকে দেখেছি। সেই ছেলে এইভাবে হারিয়ে গেল...!
'ও গাড়ি চালাতো খুব স্পিডে। আমার খুব ভয় করতো। ভাবতাম, যেভাবে গাড়ি চালায় যদি কিছু হয়ে যায়! সেদিন রাত ১১টার সময় এক ভদ্রলোক আমাকে ফোন দিলেন। জিজ্ঞেস করেন, 'সিনহা আপনার কি হয়?' আমি বললাম, 'ছেলে হয়।' এর আগে আমি ওকে ফোন দিয়েছিলাম। দেখলাম, ফোন ধরছে না। ব্যাকও করছে না। সাধারণত এরকম হয় না। ফলে ওই ভদ্রলোক ফোন দিলে আমি আঁতকে উঠি। বললেন, 'সিনহা আপনার কি হয়? বললাম, 'ছেলে হয়।' তিনি কি করেন আপনি জানেন? বললাম, 'জানি। টুকটাক কাজ করে।' জিজ্ঞেস করেন, 'আপনার কয় ছেলে-মেয়ে?' আমার তখন সন্দেহ হয়। ভাবি এত রাতে এই ভদ্রলোক আমাকে এতকিছু কেন জিজ্ঞেস করছেন। জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনি কে?' তিনি বললেন, 'আমি টেকনাফ থানার ওসি।' যখন-ই এই কথা বললেন, আমি ভয় শিউরে উঠলাম। আমি তাঁকে জানাই, আমি তো ও-কে ফোন দিচ্ছি, কিন্তু ও ফোন ধরছে না। ও-কে একটু ফোনটা দেন। উনি বললেন, 'হ্যাঁ দেওয়া যাবে। উনি একটু দূরে আছেন, দেওয়া যাবে।' এরপর ফোন রেখে দিলেন ওসি।
'কিন্তু আমি আতঙ্কের মধ্যে থাকলাম। নানা দুশ্চিন্তা ভর করল। ভাবলাম কার কাছে আমি খবর নেব এত রাতে। যারা ওর সঙ্গে কাজ করতো তাদের কারো ফোন নম্বরও আমার কাছে ছিল না। এরই ভেতর আমার মনে পড়ল, ওর দুই কোর্সমেটের ফোন নম্বর আমাকে দিয়েছিল। মেজর মোহসিন ওঁদের একজন। আমি মেজর মোহসিনকে ফোন দিলাম। জানালাম সবকিছু। সে বলল- আন্টি, আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না, আপনি ঘুমান, ওর খোঁজ নিচ্ছে।'
নাসিমা বলতে লাগলেন, 'পরের দিন ঈদের সকালে। আমি বসে আছি দুশ্চিন্তা নিয়ে। ভাবছি ঈদের দিন সকালে মেজর মোহসিনকে বিরক্ত করব কি-না। একপর্যায়ে সকাল ১০টা-১১টার দিকে আমার বাসায় পুলিশ এলো, উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ। তাঁরা আমাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন। আমিও পূর্ণ সহযোগিতা করি। জিজ্ঞেস করেন, সিনহা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল কিনা। আমি বলি, 'না'। কেননা আমি জানি, ও কখনও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। একসময় তারা চলে গেলেন।'
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে নাসিমা আক্তার বলেন, সিনহা হত্যাকে কেন্দ্র করে যেসব আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তাতে আমি সন্তুষ্ট। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। তিন বাহিনীর প্রধানরাও আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের ব্যাপারে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। আপনারা সাংবাদিকরা যা লিখছেন, তার প্রত্যেকটি লেখা আমি পড়ছি, আমার হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে। এই দেশের একটি সুন্দর পরিবর্তন আমরাই আনব, আপনারাই আনবেন। সুন্দর পরিবর্তন আমাদের দরকার। আমাদের জীবন তো শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু ছোট ছোট যেসব ছেলেমেয়ে রয়েছে, ওদের জন্য আমরা কিছু রেখে যেতে চাই, সিনহা হত্যাই যেন এই দেশে শেষ হত্যাকাণ্ড হয়।'
সান নিউজ/ আরএইচ
 
                                     
                                 
                                         
                     
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                        
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                     
                             
                             
                     
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
             
                     
                             
                             
                     
                            