ভয়াবহ পণ্যজটে বন্ধের শঙ্কা বেনাপোল বন্দর
বাণিজ্য

ভয়াবহ পণ্যজটে স্থবিরপ্রায় বেনাপোল বন্দর

রাশেদুর রহমান রাশু:

বেনাপোল (যশোর): দেশের বৃহত্তম বেনাপোল স্থলবন্দরের অধিকাংশ ক্রেন ও ফর্কলিফট অকেজো হওয়ায় স্থবির হয়ে পড়েছে মালামাল খালাস প্রক্রিয়া। আমদানিকারকরা সময়মতো পণ্য খালাস করতে না পারায় বন্দরে তৈরি হয়েছে ভয়াবহ পণ্যজট। বিরাজমান জটিলতার সমাধান না হলে যেকোনো সময় বন্ধ হতে পারে দু’দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য।

আমদানিকারকরা বলছেন, বন্দরে যেসব ক্রেন ও ফর্কলিফট ব্যবহার করা হচ্ছে তার অধিকাংশই ভাড়া করা দীর্ঘদিনের ও পুরোনো। এসব যন্ত্রপাতি দিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ কোনোমতে দায়সারা গোছের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। বন্দরের গুদামে জায়গার অভাবে সেখান পণ্য বের করার পর নতুন পণ্য ঢোকানো হচ্ছে। খালাসের অভাবে পণ্যবোঝাই ভারতীয় ট্রাকগুলোও বন্দরের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকছে দিনের পর দিন। ট্রাক থেকে পণ্য নামানোর অনুমতি মিললেও ক্রেন বা ফর্কলিফট মিলছে না। ফলে জায়গা ও ক্রেন সংকটে বিপাকে পড়েছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা।

বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, মেশিনারিসহ ভারি মালামাল লোড-আনলোডের জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করে থাকতে হচ্ছে সিরিয়াল দিয়ে। বন্দরে পন্যজট থাকায় ভারত থেকেও পণ্য নিয়ে আসতে চাচ্ছেন না সেদেশের ট্রাকচালকরা। বন্দরের ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষও বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না।

তবে বেনাপোল স্থলবন্দরে ফর্কলিফট ও ক্রেন সরবারহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিস লজিস্টিক্যাল সিস্টেম লিমিটেড বলছে ভিন্ন কথা। তাদের অভিযোগ, তারা পাঁচ বছরের চুক্তিতে ১৪ বছর ধরে কাজ করে চলেছে বন্দরে। বাড়েনি চুক্তিমূল্য, বন্দর কর্তৃপক্ষ পরিশোধ করেনি তাদের পাওনা টাকাও। ফলে বাধ্য হয়েই উচ্চ আদালতে মামলা করেছেন তারা।

বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, উচ্চ আদালতে মামলা করে সিস লজিস্টিক্যাল সিস্টেম লিমিটেডই কাজ ছাড়ছে না। ফলে দরপত্র আহ্বান করেও মালামাল লোড-আনলোডের কাজে নতুন কাউকে আনার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে।

বন্দর সূত্র জানায়, ১৯৭২ সালে বেনাপোল বন্দরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ওয়্যারহাউজিং করপোরেশনের মাধ্যমে বেনাপোল বন্দরের কার্যক্রম শুরু হয়। পরে মংলা বন্দরের অধীনে এর কার্যক্রম চলতো। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এটি বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে।

দেশের সিংহভাগ শিল্প-কলকারখানা, গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজ ও বিভিন্ন প্রকল্পের বেশিরভাগ মেশিনারিজ আমদানি করা হচ্ছে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে। ক্রেন ও ফর্কলিফট ছাড়া এ জাতীয় পণ্য বন্দরে আনলোড ও বন্দর থেকে খালাস নেওয়া সম্ভব নয়। মংলা বন্দর থেকে ২০০২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের পর অতি পুরোনো ক্রেন ও ফর্কলিফট মংলা বন্দর থেকে ভাড়া করে এনে এখানে কাজ চালাচ্ছে বেনাপোল বন্দর কর্তৃপক্ষ।

২০০৬ সালের ২১ মার্চ বেনাপোল স্থলবন্দরের পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঢাকার মহাখালীর মেসার্স সিস লজিস্টিক্যাল সিস্টেমের পাঁচ বছর মেয়াদি চুক্তি হয়। ওই বছরের ১ আগস্ট থেকে তারা বেনাপোল স্থলবন্দরে বেসরকারি কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব পায়। তারা বন্দরে ছয়টি ফর্কলিফট ও পাঁচটি ক্রেন দিয়ে মালামাল ওঠানো-নামানোর কাজ করার পর ওই বছরের ১০ নভেম্বর আরো ছয়টি নতুন ফর্কলিফট নিয়ে আসে। কয়েকদিন কাজ করার পর এসব ফর্কলিফট ও ক্রেণ অকেজো হওয়া শুরু করে। কিন্তু মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেই। চুক্তি অনুসারে পাঁচটি বিভিন্ন ধারণ ক্ষমতার ক্রেন ও ১১টি ফর্কলিফট দিয়ে পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজ করার কথা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ছয়টি ক্রেন ও নয়টি ফর্কলিফট অকেজো হয়ে পড়ে আছে।

বর্তমানে বেনাপোল বন্দরে ২৫ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ফর্কলিফট রয়েছে একটি ও পাঁচটনের ফর্কলিফট রয়েছে পাঁচটি। এর মধ্যে চারটিই দীর্ঘদিন ধরে অচল। ৪০ টন, ৩৫ টন ও ১৯ টনের ক্রেন আছে একটি করে, আর ১০ টনের ক্রেন আছে দুইটি। এসব ক্রেনের মধ্যে পাঁচটিই থাকে অধিকাংশ সময় অকেজো। বর্তমানে সবচেয়ে বড় ২৫ টনের ফর্কলিফটি অকেজো থাকায় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটছে মালামাল লোড-আনলোডে।

২০১৬ সালে বেনাপোল স্থলবন্দরে বেসরকারি কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে নতুন ঠিকাদার নিয়োগের দরপত্র আহবান করা হলে আগের হ্যান্ডলিং ঠিকাদার মেসার্স সিস লজিস্টিক্যাল সিস্টেম উচ্চ আদালতে রিট করে। এর ফলে বন্ধ হয়ে যায় দরপত্র আহবান প্রক্রিয়া। ফলে এই কোম্পানি কাজ চালিয়ে যাচ্ছে জোড়াতালি দিয়ে। আর এ কারণে এ পথে আমদানিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন দু’দেশের বন্দর ব্যবহারকারীসহ ব্যবসায়ীরা।

বন্দর ব্যবহারকারী সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, চুক্তি অনুসারে ইকুইপমেন্ট হ্যান্ডলিং কোম্পানি নতুন কোনো ইকুইপমেন্ট এখানে দেয়নি। সবই পুরোনো। মাঝে-মধ্যে মেরামতের জন্য যেসব যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয়, তার অধিকাংশই পুরোনো। ফলে মাস না ঘুরতেই ফের তা অচল হয়ে পড়ে।

ফর্কলিফট ও ক্রেন সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিস লজিস্টিক্যাল সিস্টেম লিমিটেডের বেনাপোলের ম্যানেজার ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘২০০৬ সালে আমাদের প্রতিষ্ঠান বন্দরের পণ্য ওঠানো ও নামানোর জন্য বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পাঁচ বছরের চুক্তি করে। পরবর্তীতে বন্দর কর্তৃপক্ষ আর চুক্তি নবায়ন করেনি। আমাদের কোম্পানির দেনা-পাওনাও পরিশোধ করেনি। আমরা অনেকটা বাধ্য হয়ে গত ১৫ বছর ধরে পুরোনো চুক্তিতে বন্দরের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। ১৫ বছর আগের চুক্তিতে বর্তমানে বন্দরের কার্যক্রম চালানো সম্ভব না। আমাদের দেনা-পাওনা পরিশোধ করা হলে আমরা বন্দরের কার্যক্রম গুটিয়ে নেবো।’

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন জানান, ৫১ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার বন্দরে প্রতিদিন ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টন পণ্য ওঠানো-নামানো হয়। এসব পণ্য ওঠানো-নামাতে ন্যূনতম সাতটি ক্রেন ও ৩০টি ফর্কলিফটের প্রয়োজন। সেখানে একটি ক্রেন ও দুইটি ফর্কলিফট দিয়ে কাজ করানোর ফলে সেগুলো প্রায় সময়ই বিকল হয়ে পড়ে থাকছে। প্রতিদিন শতাধিক ট্রাক পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। বন্দরের জায়গা ও ক্রেন সমস্যার সমাধান না হলে বন্দরে কার্যক্রম বন্ধ করা ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প পথ নেই।’

ব্যবসায়ীদের এসব অভিযোগের কথা স্বীকার করে বেনাপোল স্থলবন্দরের উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবীর তরফদার জানান, বর্তমানে স্থলপথের পাশাপাশি রেলপথেও প্রচুর পরিমাণ পণ্য আসছে ভারত থেকে। সেজন্য জায়গার কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে বন্দরে ক্রেন-ফর্কলিফটের সমস্যাও আছে। আইনি জটিলতায় সমস্যাগুলো হচ্ছে। অচিরেই এসব সমস্যা সমাধান করা হবে।’

আগামী দু’মাসের মধ্যে বেনাপোল বন্দরে জরুরী ভিত্তিতে ক্রেন, ফর্কলিফট, নতুন পাঁচটি শেড নির্মাণ ও জমি অধিগ্রহনের কাজ শুরু হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কে এম তারিকুল ইসলাম। তিনি সম্প্রতি বেনাপোল বন্দর অডিটোরিয়ামে বন্দর, কাস্টমস, পুলিশ, আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে বৈঠকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানান।

সান নিউজ/ এআর

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

বিপ্লবী হাদির জানাজা সম্পন্ন

ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শহীদ শরিফ ওসমান হাদির জানাজা জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় সম্...

মফস্বল সাংবাদিক ফোরামের ১১০ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন

মফস্বল ও প্রান্তিক পর্যায়ে কর্মরত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, হামলা, হ...

কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির পাশে বিপ্লবী হাদির দাফন সম্পন্ন

ওসমান হাদির দাফন সম্পন্ন হয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি প্রাঙ্গণে।...

মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে স্বতন্ত্রসহ চারজনের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ

মুন্সীগঞ্জে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীসহ চারজন প্রা...

ঝালকাঠিতে শোকে স্তব্ধ ওসমান হাদির গ্রামের বাড়ি

দক্ষিনের জেলা ঝালকাঠিতে শোকে স্তব্ধ ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শহীদ শরিফ ওসমান হ...

মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে স্বতন্ত্রসহ চারজনের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ

মুন্সীগঞ্জে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীসহ চারজন প্রা...

চাকসুর উদ্যোগে ইসলামী ব্যাংক–চবি’র কর্পোরেট চুক্তি

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি কর্পোরেট...

সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর ঝালকাঠিতে সড়ক অবরোধ প্রত্যাহার

ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার সন্তান সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগঠন ‘ইনকিলাব ম...

বাজারে কৃত্রিম সার সংকট সৃষ্টির অপরাধে ব্যবসায়ীকে জরিমানা

বাজারে কৃত্রিম সার সংকট সৃষ্টির অপরাধে কুষ্টিয়ার মিরপুরে এক ব্যবসায়ীকে জরিমান...

মফস্বল সাংবাদিক ফোরামের ১১০ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন

মফস্বল ও প্রান্তিক পর্যায়ে কর্মরত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, হামলা, হ...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা