মতামত

সচিবের মা সেরে উঠুন, অন্য মায়েদের কথাও ভাবুন

ফারুক ওয়াসিফ : সবার করোনা নয় সমান। কেউ একটা আইসিইউ বা একটা শয্যার খোঁজে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে পথেই মৃত্যুবরণ করেন, কেউবা পান রাজকীয় সেবা। একজন সচিবের মা করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে। সচিব মহোদয় প্রাণপ্রিয় মায়ের দেখাশোনার জন্য ২৪ জনকে নিয়োগ করেছেন। তাঁরা ছয় ঘণ্টার পালা করে অসুস্থ ‘মা’কে দেখাশোনা করেন। এই ২৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীর দায়িত্ব সমন্বয় করছেন সচিবের একান্ত সচিব।

ঘটনাটা মায়ের প্রতি সন্তানের অসাধারণ ভালোবাসারই প্রকাশ। ৯৫ বছর বয়সী মাকে বাঁচাতে সম্ভব সবকিছুই তিনি করেছেন। কেন করবেন না? পারলে আরও করবেন। ঘটনার এতটুকু মানবিক, ভালোবাসায় মহীয়ান এবং সুন্দর। মায়ের প্রতি এমন ভালোবাসায় অনুপ্রেরণা আসে, আবেগের নদীতে বান ডাকে।

কিন্তু মুশকিল হলো, যাঁরা এই ‘দায়িত্ব’ পালন করেছেন, তাঁরা সচিব মহোদয়ের নিজ দপ্তরের কর্মচারী। তাঁরা যে দায়িত্ব পালন করেছেন, তা তাঁদের চাকরির অংশ নয়। তাঁদের ‘ভালোবাসা’ তাই হয়তো আনুগত্যের, একে নিখাদ বলা কঠিন। রাষ্ট্রীয় কাজ ফেলে সচিব মহোদয়ের ব্যক্তিগত কাজে তাঁরা যে ন্যস্ত হলেন, এর কোনো প্রবিধান কি সরকারি কোনো নির্দেশিকায় আছে? মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের এই ব্যাপারকে ‘সামলেছেন’ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মহোদয়। তিনি বলেছেন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের করোনায় আক্রান্ত মাকে সহানুভূতি ও আবেগের জায়গা থেকে দেখতে গেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাঁর কথাও আমরা সত্য ধরে নিতে পারি। তবে যে আবেগ দেখাতে রোস্টার বা তালিকা করে যেতে হয়, সেই আবেগের উৎস কতটা মোসাহেবি আর কতটা আন্তরিক, তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে।

প্রশ্ন জাগে, এই আবেগ কেন আমরা সবাই দেখাতে পারি না। চাইলেও পারি না, চেষ্টা করেও পারি না। আমরা দেখেছি মোটরসাইকেলে স্ত্রীকে পিঠে বেঁধে হাসপাতালের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন স্বামী। গত বছরের ঘটনা—হাসপাতালে ভর্তি করাতে না পেরে, প্রতিবেশীদের আতঙ্কের চাপে পড়ে অসুস্থ মাকে জঙ্গলে ফেলে চলে গেছেন সন্তানেরা। বলে গেছেন, পরে এসে নিয়ে যাবেন। আবার আমরা এও দেখেছি, ছেলের জন্য নিজের আইসিইউ শয্যা ছেড়ে দিয়েছেন মা। ছেলে বাঁচুক—এই ভালোবাসা থেকে নিজে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর দিকে চলে গেছেন। বলা যায় বাধ্য হয়েছেন এই আত্মত্যাগে।

এ জন্যই বলি, সব করোনা যেমন সমান নয়, সবার করোনাও সমান নয়। যার যার ব্যক্তিগত ‘করোনা’ মানুষ ব্যক্তিগত সামর্থ্যেই সামলাচ্ছে। সচিব মহোদয় যেমন তাঁর ‘ক্ষমতাবলে’ সম্ভব যা কিছু সব করছেন। এটা তাঁর দোষ নয়। তিনি ভালো করেই জানেন কী হাল আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার। জানেন যে রোগীর চাপে হিমশিম খাওয়া স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে কাজ করাতে বাড়তি বুস্টার ডোজ দরকার। সেহেতুই ২৪ জন সরকারি ‘সেবক’ নিয়োগ করা।

কিন্তু যাঁরা হাসপাতালে ভর্তিই করাতে পারেননি, যাঁরা চিকিৎসার জন্য দোরে দোরে ঘুরে ব্যর্থ হয়েছেন, যাঁরা নিজের কোলের মধ্যে অসুস্থ স্বজনের দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার ছটফটানি দেখেছেন, তাঁরা হয়তো ভাববেন, ‘আহা রে, আমি যদি এভাবে পারতাম আমার মাকে বাঁচাতে!’

সবাই না হলেও অনেকেই বেঁচে যেত, যদি হাসপাতালে হাসপাতালে কোটি কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে না থাকত। যদি স্বাস্থ্য খাত দুর্নীতির শীর্ষ খাত থেকে নেমে আসত। যদি সরকার সাব্যস্ত করত যে আর যেখানে যা হয় হোক, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতকে আমরা কোনো দুর্নীতি ও অনিয়ম আর সহ্য করব না। তাহলে হয়তো করোনাভাইরাসকে নিজ নিজ সম্বল নিয়ে সামলাতে হতো না। সরকারি ব্যবস্থাকে পাশে পাওয়ার চেয়ে বড় সহায় আর কী হতে পারে? কিন্তু সেই সহায় কি সন্তোষজনকভাবে মিলছে? উত্তরটা আগেও নেতিবাচক ছিল, আশু ভবিষ্যতেও তা-ই থাকবে বলে আশঙ্কা।

ভয়ের জঙ্গলে ফেলে আসা মায়ের সন্তানেরা নিষ্ঠুর ছিলেন না, স্বজনকে হাসপাতালস্থ করা কিংবা অক্সিজেন সিলিন্ডার জোগাড় করায় ব্যর্থ মানুষেরাও নির্দয় ছিলেন না। ছিলেন তাঁরা অসহায়। সেই অসহায়ত্ব তৈরি করে দিয়েছে রাষ্ট্র, সরকার, মন্ত্রণালয়। এমনকি আমাদের সচিবালয়ের সচিবেরা, যাঁরা নাকি বর্তমানে সরকারের একমেবাদ্বিতীয়তম খুঁটি, তাঁরাও নিজেদের জন্য যা পারেন করেছেন, কিন্তু সাধারণ মানুষ কেবল অসহায়ত্বই বোধ করেছেন রোগে-শোকে আর অভাবে–অক্ষমতায়। অক্ষমতার সেই জ্বালাধরা চোখে ক্ষমতাবানের ভালোবাসাকে নিরীহ মনে না-ও হতে পারে।

আমরা চাই সচিব মহোদয়ের প্রাণপ্রিয় মাতা সুস্থ হয়ে উঠুন। ২৪ সেবকের ‘সহানুভূতির’ হাজিরানা বৃথা না যাক। এরপর ছোট্ট একটু চাওয়া থাকবে। সাধারণ মানুষের প্রতিও তাঁরা যেন একটু ভালোবাসা, একটু সহানুভূতি ছিটিয়ে দেন। তাতে অনেকের প্রাণ বাঁচবে, অনেকে অসহায়ত্ব আর অক্ষমতার জ্বালায় ছটফট করবেন না। নিজের কোলের মধ্যে অসুস্থ স্বজনের মৃত্যু হচ্ছে, কিন্তু কিছুই করতে পারছি না, এমন স্মৃতি তাঁদের সারা জীবন তাড়িয়ে বেড়াবে না। গণমাধ্যমে তখন এ রকম শিরোনাম তৈরি হবে না যে ‘আক্রান্ত বাবা-মা, আর পথে-হাসপাতালে সন্তানের বিভীষিকা’।

লেখক : ফারুক ওয়াসিফ, লেখক ও সাংবাদিক।

সান নিউজ/এনএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

তারেক রহমানের ৩১ দফা বাস্তবায়নে হাতিয়াতে উঠান বৈঠক

নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়াতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষ...

ইসলামী ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিশেষ যোগ্যতা মূল্যায়ন পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ

ইসলামী ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিশেষ যোগ্যতা মূল্যায়ন পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ ইসলাম...

বাগেরহাটের কলার বাম্পার ফলন

বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে কলার বাম্পার ফলন হয়েছে। জমিতে বসেই কলার দাম ভালো পাওয়ায়...

ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে শাপলা চত্বরের ঘটনা

ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে শাপলা চত্বরের গণহত্যার ঘটনা এমন মন্তব্য কর...

একীভূত হচ্ছে না গণঅধিকার পরিষদ ও এনসিপি

সম্প্রতি গুঞ্জন উঠে দেশের তরুণদের নিয়ে গঠিত দল দুইটি একীভূত হওয়ার বিষয়ে। তবে...

২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরও ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৩৯৬

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২৪ ঘণ্টায় আরও দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর এইডস ম...

আ. লীগের ঘাপটি মেরে থাকা অনুচরেরা এখনো তৎপর

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজ...

লুটপাটের ভিডিও করায় সাংবাদিককে হেনস্তা 

লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য নুর উদ্দিন চৌধ...

গাজাগামী ত্রাণবাহী জাহাজ আটক, নিরাপত্তার দাবি জামায়াতের

গাজামুখী ত্রাণবাহী জাহাজ আটক করার ঘটনায় ইসরায়েলের ন্যাক্কারজনক ভূমিকার তীব্র...

আপিলেও জয়ী সেই আরিফ, এখন পৌর মেয়রের শপথের অপেক্ষায় 

কুষ্টিয়ার মিরপুর পৌরসভায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করা মো. আরিফুর রহ...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা