সুন্দরবনের উপকূলে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে ড্রাগন, মাল্টা, পেয়ারা–সহ বিভিন্ন ফলের চাষ বেড়েছে। পাশাপাশি মাঠে শীতকালীন সবজি, পেঁপে, কলা, আখ, ধানসহ নানা শস্যেরও চাষ হচ্ছে। তবে ফসল চাষে যে পরিমাণ রাসায়নিক সার প্রয়োজন, সে তুলনায় পর্যাপ্ত সার পাচ্ছেন না কৃষকরা।
আমন ও রবি শস্যের ভরা মৌসুমে রাসায়নিক সারের তীব্র সংকটে বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। কৃষকরা দোকান থেকে দোকানে ঘুরেও পাচ্ছেন না প্রয়োজনীয় সার। আর যে সামান্য সার পাওয়া যাচ্ছে, তা কিনতে হচ্ছে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি মূল্যে। এতে কৃষকরা পড়েছেন মহাবিপাকে।
তবে জেলা কৃষি বিভাগ বলছে, পর্যাপ্ত সার আছে, যা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কৃষকদের দেওয়া হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে ইউরিয়া ও এমওপি সারের তেমন ঘাটতি না থাকলেও টিএসপি ও ডিএপি সারের তীব্র সংকট রয়েছে। চাষিরা ডিলারদের কাছে সার নিতে গিয়ে বারবার খালি হাতে ফিরছেন। অনেক এলাকায় সার কিনতে কৃষকদের লম্বা লাইন দিতে দেখা গেছে।
অনেক চাষি অভিযোগ করে বলেছেন, ডিলারদের কাছে সার থাকে না, অথচ বেশি টাকা দিলে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে সার পাওয়া যায়।
মোরেলগঞ্জের ভাষাদল গ্রামের মুন্না ডেকরেটরের মালিক ও চাষি মো. আব্দুল জলিল তালুকদার বলেন, “বৃষ্টির পরে জমিতে সার দেওয়া একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এখন সার প্রয়োগের উপযুক্ত সময়। কিন্তু কোথাও সার পাওয়া যাচ্ছে না। ডিলারের কাছে যখনই যাই, তারা বলে সার নেই। আমি শীতকালীন সবজি ও আমন ধান চাষ করেছি। এখন আমার ৩–৪ বস্তা সার দরকার, কিন্তু পাচ্ছি না। ভরা আমন মৌসুম চলছে, ধানের গাছ বড় হচ্ছে। এখন যদি সার না দিই, ফলন কমে যাবে। আমরা সারের জন্য দৌড়াদৌড়ি করছি, কেউ সঠিক দামে দিচ্ছে না, আবার চাহিদা অনুযায়ীও মিলছে না। এতে আমন মৌসুমেই আমরা ক্ষতির মুখে পড়ছি।”
মোরেলগঞ্জ উপজেলার উমাজুড়ি গ্রামের সফল চাষি শাহজালাল বাবু জানান, “টিএসপি সার কেনার জন্য গতকাল ভোর থেকে ডিলারের দোকানের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে মাত্র ২৫ কেজি সার পেয়েছি। আমার ৭ বিঘা জমিতে চাষ আছে, এতোটুকু সারে কিছুই হবে না।”
ডিলারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টিএসপি সারের চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম। এই অল্প পরিমাণ সার দিয়ে কৃষকের বিপুল চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বরাদ্দের সার আসামাত্রই ১–২ দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। কিছু অসাধু খুচরা ব্যবসায়ী সাধারণ মানুষকে কৃষক সাজিয়ে ডিলারের কাছ থেকে সার তুলে পরে দোকানে বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
খুচরা সার ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেন, ডিলাররা তাদের যথাযথভাবে সার দিচ্ছেন না। ফলে দোকানগুলোতে পর্যাপ্ত সার থাকছে না। কৃষকরা তাদের কাছ থেকে সার চাইলে তারাও চাহিদা মতো দিতে পারছেন না।
মোরেলগঞ্জ রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি এস. এম. সাইফুল ইসলাম কবির বলেন, “স্থানীয় কৃষকরা মনে করেন, সঠিক দামে ও পর্যাপ্ত সার সরবরাহ করা হলে কৃষিতে আবারও সুদিন ফিরবে। কৃষকদের সার, বীজ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহযোগিতা করা জরুরি। বিভিন্ন সিড কোম্পানির পক্ষ থেকেও মাঝে মাঝে সার ও বীজ দিয়ে দরিদ্র কৃষকদের সহযোগিতা করা উচিত।”
তিনি আরও বলেন, “কৃষিপ্রধান বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। আবার এই মোরেলগঞ্জ দারিদ্র্যের শীর্ষে এবং নদীভাঙনের কারণে প্রতিবছর হাজারো কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন। তার ওপর সার সংকট কৃষকদের জন্য নতুন দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
মোরেলগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, “মোরেলগঞ্জ উপজেলায় সারের তেমন সংকট নেই। আমাদের জমিতে যতটুকু প্রয়োজন, তার ৫–৬ গুণ বেশি সার প্রয়োগ করার কারণেই সংকট দেখা দিচ্ছে। যে জমিতে ২০ কেজি টিএসপি সার প্রয়োগের দরকার, সেখানে ১০০ কেজি করে দেওয়া হচ্ছে। অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে জমির স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, উর্বরতা কমে আসছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০–২৫ বছরের মধ্যে অনেক জমি প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে কৃষিজমিতে বেশি করে জৈব সার ব্যবহার করতে হবে। এতে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকবে এবং সারের সংকটও তৈরি হবে না।”
সাননিউজ/আরপি