ঢাকার আকাশ শুধু কম্পনের শব্দে নয়, ভয়ের অনুভূতিতেও কেঁপে উঠছে। গত শুক্রবার সকালে ঢাকার আকাশ কেঁপে উঠেছিল আচমকা এক শক্তিশালী ভূমিকম্পে। মুহূর্তেই রাজধানীজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক দশকের মধ্যে এটি দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে একটি। এতে অন্তত ১০ জনের প্রাণহানি ঘটে এবং ছয় শতাধিক মানুষ আহত হয়। প্রাথমিক কম্পনের ৩২ ঘণ্টার মধ্যে আরও তিন দফা ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই ভূমিকম্পগুলোর উৎপত্তিস্থল ছিল দেশের ভেতরে নরসিংদী, মাধবদী, সাভারের বাইপাইল ও বাড্ডা যা ঢাকার নগরবাসীর আতঙ্ককে তীব্র করেছে।
ঢাকার পুরোনো ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ। তিলোত্তমা, শাহবাগ, পুরান ঢাকা এই সব এলাকায় প্রশাসনিক দুর্নীতি ও যাচাই-বাছাই ছাড়া ভবন নির্মাণের ইতিহাস শহরের নিরাপত্তাকে হুমকিতে ফেলেছে। অবৈধ ও নিম্নমানের নির্মাণ, কাঠামোগত দুর্বলতা এবং সরকারি তদারকির অভাব মিলিত হয়ে রাজধানীকে ঝুঁকিপূর্ণ নগরীতেই পরিণত করেছে। বংশালের এক গৃহিণী আসমা বেগম বলেন, “ভূমিকম্প শুরু হতেই আমরা বাচ্চাদের নিয়ে দৌড়ে নিচে নেমে যাই। ভবনগুলো এত ঘন এবং পুরোনো যে নামলেও বাঁচার উপায় নেই। সত্যি বলতে, কেউ জানে না কী হবে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের ভূগোল তিনটি শক্তিশালী প্লেটের সংযোগবিন্দুতে ইউরেশিয়ান, ইন্ডিয়া এবং বার্মিজ সাব-প্লেট। ঢাকার অবস্থান এই ত্রিমুখী প্লেটের সংযোগ এলাকায় হওয়ায় ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা স্বাভাবিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এম. সাইফুল ইসলাম বলেন, “এই অঞ্চলে ছোট-বড় বিভিন্ন মাত্রার ভূমিকম্প স্বাভাবিক। তবে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব এবং তা নাগরিকদের সচেতনতা ও প্রস্তুতির ওপর নির্ভর করছে।”
প্রকৌশল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার সব ভবনেরই কাঠামোগত নিরাপত্তা পরীক্ষা ও সংস্কারের প্রয়োজন। রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রিয়াজুল ইসলাম উল্লেখ করেছেন, “অবহেলা ও দুর্নীতি মিলিত হয়ে বিপদের আশঙ্কা আরও বাড়াচ্ছে। নির্মাণের নিয়ম না মানা এবং যাচাই-বাছাইহীন ভবন নগরের জন্য একটি বিষ্ফোরক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কারণে অস্থায়ী ছুটি ঘোষণা করেছে। শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ আবাসিক ভবনের পরিদর্শন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রভোস্ট কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ী, শিক্ষার্থীরা মূল্যবান জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে রুমের চাবি হল প্রশাসনের কাছে জমা দেবে।
সরকারি উদ্যোগেও ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর ইমার্জেন্সি রেসপন্স সেল গঠন করেছে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছে। তাছাড়া গ্যাস কূপে খনন ও ভূতাত্ত্বিক জরিপ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে এ সব পদক্ষেপই সীমিত এবং নাগরিক সচেতনতা ছাড়া বড় বিপদ ঠেকানো সম্ভব নয়।
ভূমিকম্পের সময় করণীয় বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্স আট দফা নিরাপত্তা নির্দেশনা দিয়েছে। খোলা মাঠে আশ্রয় নেওয়া, শক্ত টেবিলের নিচে আশ্রয় নেওয়া, বহুতল ভবনে ড্রপ-কভার-হোল্ড পদ্ধতি অনুসরণ করা, লিফট ব্যবহার না করা এবং বৈদ্যুতিক ও গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পরিবার ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে জরুরি খাদ্য, পানি এবং মেডিকেল সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পুরো নগরীই এখন সতর্ক। নাগরিকরা আতঙ্কিত, কিন্তু প্রস্তুতি নিলে ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ নগর কাঠামো, প্রশাসনিক দুর্নীতি ও যাচাই-বাছাইহীন নির্মাণ এক সমন্বিত ঝুঁকি তৈরি করেছে। তাই প্রত্যেক বাসিন্দাকে নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার জন্য পূর্বপরিকল্পনা ও সচেতনতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে।
ভূমিকম্প ঠেকানো সম্ভব নয়, তবে প্রস্তুতি ও সতর্কতা গ্রহণে ঢাকা শহরের ঝুঁকিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে। নাগরিক এবং প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগই শহরের ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করতে পারে।