পণ্ডিত পবিত্র মোহন দে
মতামত

পবিত্র দে’র কর্মময় জীবন

সজীব সরকার

পণ্ডিত পবিত্র মোহন দে (জন্ম ১ মে, ১৯৩৭ আকুয়া চুকাইতলা, ময়মনসিংহ), পিতা- প্যারী মোহন দে, মাতা- শ্যমা সুন্দরী দে। এ শতাব্দীর ২য় ও ৩য় দশকে ময়মনসিংহে বিশেষ করে মুক্তাগাছার জমিদার জগৎ কিশোর আচার্যের, গৌরীপুরে, ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, রাম গোপালপুরের ও ময়মনসিংহ শহরে শশীকান্দ আচার্যের দরবারে হিন্দুস্তানী উচ্চাঙ্গ সংগীতের বহু খ্যাতনামা কলাবন্ত এসে এক স্বর্ণযুগ সৃষ্টি করেছিলো।

তবলা বাদনে মুক্তাগাছায় বেনারসের মৌলভীরাম মিসির, গৌরীপুরে ফরাক্কাবাদ ঘরানার (দিল্লী) মসিদ খাঁ (ওস্তাত কেরামত উল্লার খাঁর পিতা) এবং সেতারের কিংবদন্তী এনায়েৎ খাঁর (বেলায়েত খাঁর পিতা) উপস্থিতি ময়মনসিংহকে উচ্চাঙ্গ সংগীতের এক অনন্য ভূবন সৃষ্টি করেছিলো।

তবলা বাদনে মৌলভীরাম ও মসিদ খাঁর ঘরানার মিশ্রণ হলো ময়মনসিংহে। এ মিশ্রণের অনন্য ফসল হলো পন্ডিত বিপিন রায়, উপেন রায়, রাম কৃষ্ণ কর্মকার, মিথুন দে ও অন্যান্য কালজয়ী শিল্পী ও শিক্ষক। সই সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের দীপশিখাকে ধরে রাখতে পেরেছিলেন বিপিন বিজয় মিথুন।

সেতারে বিপিন দাস, কণ্ঠে বিজয় কৃষ্ণ ভট্টাচার্য এবং মিথুন দে তবলায় ও কণ্ঠে। এঁদের উত্তরসূরী হিসাবে পারুল ভীষ্ম আভা পঞ্চাশ দশকের শেষ দিক থেকে উচ্চাঙ্গ সংগীতকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলো ষাটের দশক পর্যন্ত।

কৃতি অগ্রজ মিথুনদের তালিম নিয়ে পবিত্র তবলা বাদনের ধারাকে বহন করে আসছে পরিশীলিত গানের মাইফেলে। পঞ্চাশ ষাট সত্তর আশির দশক পার হয়ে একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করলেন পবিত্র দে। খেয়ালগান, রবীন্দ্র সংগীত ও উচ্চাঙ্গী নৃত্যের সংগতে পবিত্র দে এক অসাধারণ প্রতিভা। তার সমৃদ্ধ ও শৈল্পিক বাদন অমৃতের ধারা বয়ে দেয়- গান হয়ে উঠে ছবি এবং অফুরন্ত আনন্দের উপকরণ।

মিথুনদের জীবদ্দশাতেই পবিত্র দে তবলা শিক্ষাদান ও বাদনে ময়মনসিংহ ও বাংলাদেশে এক অনন্য স্থানে আসন করে নিয়েছেন। উচ্চাঙ্গঁ ও পরিশীলিত সংগীতে আমাদের চারপাশে পবিত্রদের মত যোগ্য মানুষ নেই।

কোলকাতায় শিক্ষাপ্রাপ্ত ধ্রুপদ, বেলজিয়াম গায়ক ফিলিপ ফালিস ১৯৮৫তে তার পাখোয়াজ বাদানে অভিভূত হয়ে ছিলেন ঢাকা ব্রিটিশ কাউন্সিলে এক সংগীত আসরে। সেখান অনেক গণ্য-মান্য শ্রোতা ছাড়া ওয়াহেদুল হক এবং আসাদুজ্জামান নূর উপস্থিত ছিলেন। যদিও নূর সাহেব তখন সংস্কৃতিমন্ত্রী ছিলেন না।

পবিত্র দে ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করার পর আনন্দ মোহন কলেজে ভর্তি হয়। সেখানে শিক্ষক পান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সৈয়দ বদর উদ্দিন হোসেন এবং আরও বিশিষ্ট অধ্যাপকদের।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও সৈয়দ বদর উদ্দিন হোসেন পড়াতেন ইতিহাস। এছাড়া তাঁরা কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নাট্য বিভাগে যুক্ত ছিলেন। পবিত্র দে কলেজে পড়া অবস্থায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নাটকে তবলা সংগত করতেন। আলোকময় নাহা উক্ত কলেজে পড়তেন, যদিও পবিত্রদের সিনিয়র ছিলেন। অনুষ্ঠানে গান গাইতেন আলোকময় নাহা ও অন্যান্যরা। সেই সুবাদে পবিত্রদের ভালো পরিচিতি হয় সকলের সাথে। আলোকময় নাহা প্রায়ই পবিত্রদেকে বাসায় নিয়ে যেতেন গান সংগত করার জন্য।

একদিন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ব্যক্তিগত কাজের জন্য কলেজের অফিস কক্ষে যান। কাজের ফাঁকে বললেন মোহিনী বাবু আমার ছেলে-মেয়েদের বাসায় পড়ানোর জন্য একজন প্রাইভেট শিক্ষকের ব্যবস্থা করে দেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে মোহিনী দে পবিত্রদের মেঝো ভাই। তখন মোহিনী দে বললেন, স্যার, আমার ছোট ভাই আপনার ছাত্র, এ কলেজে পড়ে। পরে নজরুল সাহেব বললেন ওর নাম কি? পবিত্র দে। ও চিনতে পেরেছি, তবলা বাজায়, হ্যাঁ স্যার। আপাতত ও পড়াক, উপরের ক্লাসের দিকে উঠলে আমি পড়াবো। উত্তরে নজরুল সাহেব বললেন ঠিক আছে। আপনি আমার বাসা চিনেন তো?

তখন মোহিনী দে (মোহিনী দে কলেজে ক্লারিকেল পোস্টে চাকরি করেন) হ্যাঁ স্যার চিনি। তখন নজরুল সাহেব বললেন পবিত্রকে বাসায় নিয়ে যাবেন আমি বাসায় বলে রাখবো। একদিন মোহিনী দে পবিত্রকে বাসায় নিয়ে গেলেন। ছেলে-মেয়েদের ডেকে পরিচয় করে দিয়ে বললেন এই স্যার এখন থেকে তোমাদের পড়াবেন। পবিত্র দে যথারীতি পড়াতে লাগলেন। একদিন পড়ানোর ফাঁকে পবিত্রদে শুনতে পেলেন ভিতরে নজরুল সাহেব বলতেছেন মাস্টারকে ভাল নাস্তা দিবে। সে একজন ভালো তবলা বাদক, আমার ছাত্র। সে খুব ভালো তবলা বাজায়, কলেজের অনুষ্ঠানে তার তবলা বাদন শুনেছি।

পবিত্র দে কেবল সংগীতের ক্ষেত্রে পারদর্শী নয়। ছোটবেলা থেকেই ভালো ছবি আঁকা তার একটা সখ। যদিও ছবি আঁকা মেঝো ভাই মোহিনী দেকে অনুসরণ করেই হয়েছে। মোহিনী দে ছাত্র জীবন থেকে ছবি আঁকতেন। আনন্দ মোহন কলেজে বোটানি ও বায়োলজি এবং মুমিনুন্নেছা কলেজে বায়োলজি ও বোটানি ডিপার্টমেন্টে যে সব ছবি সেগুলো পবিত্র দে, মোহিনী দে ও হেমেন্দ্র ভট্টাচার্য্য এর হাতের আঁকা।

এছাড়া পবিত্র দে মৃৎশিল্পেও পটু ছিলেন। ছাত্র অবস্থায় বহু মাটির মডেল তৈয়ার করেছেন, যা প্রশংসনীয়। পবিত্র দের আর একটি প্রশংসনীয় ব্যাপার হলো তার বাংলা এবং ইংরেজী হাতের লেখা। এই সমস্ত বিষয় উপেক্ষা করে সংগীত চর্চাতেই মনোযোগ দেন এবং অগ্রজ মিথুনদের কাছে তবলার তালিম নিতে থাকেন। উনার কাছ থেকেই তবলার তালিম শেষ করেন। তৎসময়ে ময়মনসিংহ শহরে অনুষ্ঠানে তবলা বাদক একমাত্র পবিত্র দে, যার ফলে কলেজের পড়া আর হয়ে উঠে নই।

পাকিস্তান শাসনকালে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শিক্ষকতা ছেড়ে ময়মনসিংহ বারে যোগ দেন এবং আইন ব্যবসা শুরু করেন। তারপর তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মিথুন দে ও তার বন্ধু-বান্ধবরা যে সমস্ত বড় বড় সংগীত অনুষ্ঠান করতেন, প্রায় সব অনুষ্ঠানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হতেন। পরে অবশ্য ঢাকায় চলে যান।

পবিত্র দে ২/৩ মাসের জন্য পশ্চিম বঙ্গের আলীপুর দুয়ার, কুচবিহার এবং অন্যান্য জায়গায় বেড়াতে যান। সেখানে অনেক সংগীত শিল্পীদের সাথে পরিচয় করে নেন। মাঝে মধ্যে তাঁদের সাথে সংগীত আসরে বসে তবলা সংগত করে প্রশংসা পান। আলীপুর দুয়ারে রবীন্দ্র নাথ ঘোষ নামে (রবী ঘোষ) এক সংগীত শিল্পীর সাথে পরিচয় হয়। তিনি একটি সংগীত স্কুল চালান। সেখানে ছেলে-মেয়েদের গান শেখান। গানের ক্লাস শেষ করে অনেক আলাপচারিতার পর বললেন পবিত্র বাবু আগামীকাল আসলে ভালো হয়, কারণ আগামীকাল ক্লাস নেই। আজ আর গাইবো না একটু পরিশ্রান্ত। আপনার তো অসুবিধে নেই তখন পবিত্র দে বললেন না- অবশ্যই আসবো। পরদিন সন্ধেবেলায় পবিত্র দে গেলেন। রবী ঘোষ প্রথম রাগ সংগীত গাইলেন। পবিত্র দে তবলা সংগত করলেন। গান শেষ করে পবিত্রকে বললেন আপনি ভালো তবলা বাজান। তারপর অনেক ধরনের গান গাইলেন। পবিত্রদের তবলা সংগতে রবি ঘোষ খুবই প্রশংসা করলেন। রবী ঘোষ একজন ভালো সংগীতশিল্পী ও শিক্ষক।

দেশে ফিরে এসে পবিত্র ১৯৬৪ সনে ময়মনসিংহ রোডস এন্ড হাইওয়েজ ডিপার্টমেন্টে চাকরি গ্রহণ করেন। তখন ইংরেজি টাইপে অফিসের কাজ হতো। পবিত্র ইংরেজি টাইপ ভালো শিখেছিলো। চাকরি করা অবস্থায় নাইট কলেজে ভর্তি হন এবং যথারীতি বি.এ পাশ করেন। চাকরির ফাঁকে ময়মনসিংহে যত সংগীত অনুষ্ঠান হতো সমস্ত অনুষ্ঠানেই পবিত্র দের উপস্থিতি। কারণ তখনকার সময়ে তবলা বাদকের খুব অভাব ছিলো। পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ৬০ দশকের শেষ দিকে অর্থাৎ ৬৭-৬৮ পর্যন্ত সমস্ত শ্রেণীর সংগীত এবং নৃত্য ও যন্ত্র সংগীত এর খুব একটা চর্চা বহন করে এসেছিলো। তার মধ্যে নৃত্যে এবং খেয়াল গান খুবই প্রসার লাভ করে। ময়মনসিংহ শহরে সীতারাম অয়েল মিলস্ এর কাছে ফকর উদ্দিন আহম্মদ এর বাসায় শামিম- আরা নীপা, তার বড় বোন মুনসুরা বেগম দুলা, ভাই ফখর উদ্দিন আহমেদের বাসায় থেকে গান ও নৃত্য চর্চা করতো। ফখর সাহেবের দুই মেয়ে গান এবং নৃত্য চর্চা করতো। এই বাসায় শেখাতেন মিথুন দে গান এবং নাচ শিখাতেন যোগেশ দাস।

এছাড়া কমল সরকার ও রত্না সরকার এবং বিপুল ভট্টাচার্য এখানে এসে অনেক বিষয় (নৃত্য ও সংগীত) এর ধারণা নেয়ার জন্য মিথুন দে ও যোগেশ দাস এর কাছে আসত। এদের প্রত্যেকের সাথে পবিত্র তবলা সংগত করতো। পরবর্তীতে এরা সকলে ঢাকা চলে যায়। পবিত্র দে চাকরির সুবাদে ময়মনসিংহে রয়ে গেলেন।

১৯৭০ সনে যখন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় তখন পরিবারের সকলেই কোলকাতা চলে যান। সেখানে পৌঁছে পবিত্র দের মেঝো ভাই মোহিনীদে সৈয়দ নজরুলের সাথে দেখা করে বলেন, স্যার এখানে পরিবার-পরিজনসহ জীবন বাঁচাতে এসেছি, আমাকে একটা ব্যবস্থা করে দেন। তখন নজরুল সাহেব বললেন আপনারা এত দেড়ী করলেন কেন? কতজনকে চাকরি দিলাম। আপনাদের কাউকেই দেখি না। এখন তো প্রায় শেষ সময়। তবুও তিনি মোহিনীদেকে হতাশ করেন নাই। ঐ সময় নজরুল সাহেব থাকতেন কোলকাতায় অশোক ঘোষের বাসায়। উনার কথা রাখলেন এবং বললেন মোহিনী বাবু প্রথমে ৯.০০-৯.৩০ টায় এসে ছেলে-মেয়েদের পড়াবেন পরে থিয়টার রোডে আমাদের বাংলাদেশ অফিসে চাকরিতে জয়েন করবেন। ওখানে পীযুষ বাবু এবং ময়মনসিংহের অনেকে চাকরি করে। আমি পীযুষ বাবুকে বলে দিচ্ছি। এরপর বললেন আপনার ছোট ভাই ওর নামটা জানি কি! ও আসে নাই! হ্যাঁ স্যার এসেছে। ওর নাম পবিত্র, হ্যাঁ তাই। ও ময়মনসিংহে গান বাজনা করতো না অন্য আরও কিছু। তখন উত্তরে মোহিনী দে বললেন, স্যার ময়মনসিংহ রোডস এন্ড হাইওয়েজ ডিপার্টমেন্টে চাকরি করতো। উত্তরে নজরুল সাহেব বললেন ঠিক আছে। পবিত্র ময়মনসিংহ নাইট কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেছে। এখন আর চাকরি দেওয়ার মত স্থান নেই। কিছুদিনের মধ্যে দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে। ও যদি ভালো চাকরি করতে চায় দেশে গিয়ে আমার সাথে দেখা করে যেন, আমি তাকে একটা ভালো চাকরি দিয়ে দিবো। আপাততঃ ওকে আপনি কিছু কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করবেন।

একদিন মোহিনীদে পবিত্রকে জানালেন আমি নজরুল সাহেবকে ধরে একটি চাকরির ব্যবস্থা করেছি। পরে বললেন ৯.০০-৯.৩০ মিঃ মধ্যে আমার সাথে কোলকাতা অশোক ঘোষের বাসায় দেখা করবি। আমি নজরুল সাহেবের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা করানোর পর থিয়েটার রোডে চাকরি করার জন্য চলে যাই। পবিত্র দে মাঝে মাঝে ওখানে যেতেন এবং মোহিনী দে তাকে কিছু টাকা দিয়ে দিতেন। ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সন দেশ স্বাধীন হলে পবিত্র দে দেশে ফিরে চাকরিতে জয়েন করলেন। তারপর মোহিনীদে নজরুল সাহেবের পরিবারকে ঢাকা পৌঁছিয়ে দেন।

উল্লেখ্য যে পবিত্র দে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কোলকাতায় শরনার্থী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সহিত পরিচয় করে নিলেন। সেখানে ঢাকার ওয়াহেদুল হক সাহেবের সাথে দেখা করেন। ওয়াহেদুল হক সাহেব পবিত্রকে অন্য একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন এর সহিত যুক্ত করে দেন, যার সংগীত মহড়া হতো পদ্মপুকুর এর একটি দোতলা বাসায়। ঐ সংগঠনটির মধ্যে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলার শিল্পীরা ছিলেন। তার মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ।

এইসব জেলার শিল্পীরা নানা সংগঠনে ভাগ হয়ে স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের গান নিয়ে রিয়েরসাল শুরু করে। এই মুহূর্তে সমস্ত শিল্পীদের নাম মনে নেই, যাদের কথা মনে আছে তার মধ্যে ওয়াহিদুল হক, কমল সরকার, রতœ সরকার, সুশান্ত সাহা, বিপুল ভট্টাচার্য্য, দীপক মুখার্জি, মিতালী মুখার্জ্জি এবং পবিত্র দেসহ আরও অনেকে। এরা সবাই পদ্মপুকুর এর একটি দোতলা বাসায় সংগীতের মহড়া করতেন। ঐ বাসাটি শিল্পীদের জন্য ভারত সরকার বরাদ্দ করেন। সপ্তাহে একদিন সংগীত মহড়া বন্ধ থাকত রোববার। প্রতি রোববার পবিত্র চলে যেতেন চাকদাহ, সেখানে ভীষ্ম দেব ভট্টাচার্য থাকেন। ভীষ্ম দেব ময়মনসিংহ এর বিজয় কৃষ্ণ ভট্টাচার্য্যরে বড় ছেলে, ভালো উচ্চাঙ্গ সংগীত গায়। সে ১৯৬৫ সনে ওদেশে চলে যায়। পবিত্র তার সাথে তবলা সংগত করতেন।

পদ্মপুকুর একমাস অবধি রিয়েরসাল শেষে অনুষ্ঠানটি মঞ্চস্থ হয় কোলকাতার মহাজাতি সদনে। উপস্থিত দর্শক শ্রোতাদের অনুষ্ঠানটি খুব উপভোগ্য হয়।
চাকরির ফাঁকে গান বাজনা চালিয়ে যান পবিত্র। গান বাজনাটা পারিবারিকভাবেই এসেছে। ময়মনসিংহ শহরে যে সব সংগীত অনুষ্ঠান হতো তা স্থানীয় এবং ঢাকা থেকে আগত মুনসুরা বেগম, নীলোৎপল সাধ্য, ওয়াহেদুল হক, মিতা হক আরও অনেকের উপস্থিতি ছিলো। তাদের সাথে তবলা এবং পাখোয়াজ সংগত করতেন পবিত্র দে। ময়মনসিংহ রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ গঠন হয়। প্রতি বছর রবীন্দ্র সংগীত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো বর্ণিত শিল্পীরা কর্মশালায় আসতেন এবং প্রতিযোগিতা পরিচালনা করতেন। প্রতিযোগীতায় পবিত্রদের তবলা পাখোয়াজ সংগতে প্রশংসা অর্জন করেন।

এছাড়া আধুনিক গান, নজরুল সংগীত, বাউল, ভাটিয়ালী গানের শিল্পীরা ঢাকা থেকে আসতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। তাদের মধ্যে মহাম্মদ উন নবী, খন্দকার ফারুক আহম্মদ, সোহরাব হোসেন, মুনসুরা বেগম, ফরিদা ইয়াসমিন এবং আরো অনেকে। তাদের সাথে পবিত্র দে তবলা সংগত করতেন। পবিত্র দে কেবল গানেই নয় নাচে ও তবলা সংগতে সিদ্ধহস্ত। অগ্রজ মিথুন দে তবলা ছেড়ে উচ্চাঙ্গ সংগীত আয়ত্ত করেন এবং শিক্ষকতায় মনোযোগ দেন।

সফল শিক্ষক হিসাবে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন যার ফলশ্রুতিতে তিনি তৈয়ার করেন আভা আলম, মঞ্জু ভৌমিক, গৌরী সেন, উন্দীরা নিয়োগী, সুমিতা নাহাদের মত সফল ছাত্রী। সকলের সাথে পবিত্র দে তবলা সংগত এক অপূর্ব সংগীত পরিবেশ সৃষ্টি হতো যা তার অগ্রজ মিথুন দে স্বীকার করেছেন। পবিত্র দে যন্ত্র সংগীতেও সিদ্ধ হস্ত। যাঁদের সাথে সংঘত করেছেন, (পন্ডিত বিপিন দাস, দ্যুতী কিশোর আচার্য্য, দেব কুমার ভৌমিক, অরুণ কুমার ভৌমিক) তাঁরা সবাই সেতারে সিদ্ধ হস্ত।

তিনি আরও যাদের সাথে সংগীত অনুষ্ঠানে তবলা সংগত করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন বাংলা গানের অবিস্মরণীয় শিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, বিখ্যাত খেয়াল গায়ক বীরেশ রায়, বিখ্যাত খেয়ালীয়া সালামত আলী খাঁ, নাজাকাত আলী খাঁ, আমানত আলী খাঁ, ফতেহ আলী ভ্রাতৃদ্বয়, বিখ্যাত রবীন্দ্র সংগীত বিশেষজ্ঞ শ্রী শৈলজা রঞ্জন মজুমদার, তালাদ মাহমুদ, সানজিদা খাতুনসহ আরো অনেকে।

১৯৬৫ সনে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে এক সংগীত প্রতিযোগিতা হয়। সেই জাতীয় প্রতিযোগিতার আয়োজন হয় পন্ডিত বারনী মজুমদার পরিচালিত সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মিউজিক কলেজ) এ।

উক্ত প্রতিযোগিতায় ময়মনসিংহের নাচের শিক্ষক যোগেশ দাস এর ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে পবিত্র দে উচ্চাঙ্গ, আধুনিক, ফোকসহ সমস্ত নৃত্যের সাথে সংগত করে প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে ১ম, ২য় ও ৩য় স্থান দখল করে এন দেন তার অপূর্ব তবলা সংগতের মাধ্যমে। সেই প্রতিযোগিতায় বিচারকমন্ডলী ছিলেন, ঝুনু খান, জি,এ মান্নান, গহর জামিলসহ আরও অনেকে।
পন্ডিত মিথুন দে একদিন নাচের শিক্ষক যোগেশ দাসকে বললেন, যোগেশ এতদিনতো পবিত্র (১০/১২ বৎসর) তবলা বাজাল এখন তুমি কেসেট এর সাহায্যে নাচ শেখাও। কেসেট বেরিয়ে গেছে ভালো ভালো কেসেট। এখন থেকে পবিত্র আর নাচে তবলা বাজাবে না, ওর হাত তবলায় খুব কর্কশ হয়ে গেছে। নাচের সাথে তবলা সংগত বাদ দিয়ে পবিত্র আবার নতুন করে রেওয়াজ এর মাধ্যমে হাতের মিষ্টত্ব ফিরিয়ে আনেন।

গুণী পবিত্র দে পরিশিলীত সংগীতে তবলা পাখোয়াজ বাদন এবং শিক্ষা ও দেশ সেবায় নিবেদিত যার ফলশ্রæতিতে নি¤েœ প্রদত্ত বিভিন্ন সংগীত সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান তাকে সংবর্ধনা দিয়ে সম্মানিত করেছে ঃ
১) উদীচী ময়মনসিংহ জেলা শাখা পরিচালিত আলোকময় নাহা সংগীত বিদ্যায়তন সম্মাননা ১৯৮৪ সন।
২) জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন অষ্টা বিংশ জাতীয় সম্মেলন মার্চ, ২০০৯ সন।
৩) মহামান্য রাষ্ট্রপতির হাত থেকে শিল্পকলা পদক গ্রহণ ২০১৬ সন।
৪) বিশ্ব সংগীত দিবস, বাংলাদেশ সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, ময়মনসিংহ বিভাগ ২০১৯ সন।
৫) উদীচী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ সম্মাননা ১৯শে সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ সন।
৬) জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ (কেন্দ্রীয়) ঢাকা থেকে সম্মাননা (অষ্টবিংশ জাতীয় সম্মেলন) ২২ মার্চ ২০০৯।
৭) জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ ময়মনসিংহ জেলা শাখা, ময়মনসিংহ সম্মাননা ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ সন।
৮) যন্ত্র সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য জেলা শিল্পকলা একাডেমী, ময়মনসিংহ সম্মাননা ২০১৫ সন।
৯) গুণীজন সম্মাননা, কিরণ স্মৃতি সংগীত বিদ্যালয়, চন্ডীপাশা, নান্দাইল, ময়মনসিংহ ২০২০ সন।

ময়মনসিংহে সরকারি চাকরির ব্যস্ততা এবং সংগীত অঙ্গনের ব্যস্ততার জন্য যাই যাচ্ছি করে ঢাকায় যাওয়া হয় নাই। সৈয়দ নজরুল সাহেব তখন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। পরবর্তীতে যখন শোনা গেলো ১৯৭৫ সনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে নিহত এবং জেলে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। তখন দেশে বিরাট গÐগোল বিধায় পবিত্রদে আর ঢাকা যান নাই।
১৯৯৫-৯৬ সনে বাংলাদেশে পিস কোর’ এর একটি দল আমেরিকার ওয়াশিংটন থেকে এসেছিলো। তারা এদেশে ৫/৬ মাস ছিলো। সে দলটিতে এডওয়ার্ড পায়াস নামে এক ভদ্রলোক ছিলেন উনি ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র পাখোয়াজ বাজান। তিনি ওয়াশিংটনে পাখোয়াজ শিখেছেন। ওখানে ভারতের বেনারসের বহু গুণী ওস্তাদ আছেন যাঁরা ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের নাচ, যন্ত্র ও কণ্ঠসংগীতের স্কুল দিয়েছেন। এডওয়ার্ড পায়াসের সাথে পরিচয় হয় প্রফেসর আ.বা.ম. নুরুল আনোয়ারের বাসায়। সে বাসায় প্রফেসর নুরুল আনোয়ার রবীন্দ্র সংগীতের আসর করতেন এডওয়ার্ড পায়াস এবং পবিত্র দে যেতেন। এডওয়ার্ড পায়াস তার পাখোয়াজ সব সময় সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। সেখানে তো প্রকৃত ধ্রপদ গান হতো না। নুরুল আনোয়ারের ছাত্র-ছাত্রীরা রবীন্দ্র দ্রুপদ ধামার গাইত তার সাথে প্রথমে এডওয়ার্ড পায়াস এবং পরে পবিত্র দে পাখোয়াজ সংগত করলেন। বিদেশি লোক হয়ে পাখোয়াজ এত সুন্দর শিখেছেন যা অতি প্রশংসার যোগ্য। এডওয়ার্ড পায়াস পবিত্র দের তবলা ও পাখোয়াজ শুনে খুব প্রশংসা করলেন।

পবিত্র দে ১৯৯৪ সনে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণ করার পর ঢাকা গিয়েছিলেন। ঢাকায় গিয়ে ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনে ৪/৫ মাস তবলা শিক্ষকতা করেছিলেন। কিন্তু সেখানে আর না থেকে ময়মনসিংহ চলে আসেন। এখানে এসে বিভিন্ন সংগীত বিদ্যালয় ও সংগীত প্রতিষ্ঠানে তবলার শিক্ষকতা করে চলেছেন। বর্তমানে পবিত্র দে অসুস্থতার কারণে আর গান বাজনা করেন না। পারিবারিক জীবনে স্ত্রী ও তিন ছেলে এক মেয়ে নিয়ে বসবাস করছেন নিজ বাড়ীতে। তার ছেলে প্রশান্ত দে ময়মনসিংহের সংগীত অঙ্গনে জড়িত।
একান্ত অনুরোধের ফলে ময়মনসিংহ উদীচী পরিচালিত আলোকময় মহাসংগীত বিদ্যায়তনে অধ্যক্ষের পদে নিয়োজিত আছেন।

পবিত্র দে তার দীর্ঘ সংগীত জীবনে একটি অবদান রেখেছেন তা হলো, কিছু তবলা বাদক তৈয়ার করেছেন। তারা বর্তমানে নিজ নিজ যোগ্যতার বলে প্রতিষ্ঠিত এবং এদেশের বিভিন্ন সংগীত বিদ্যায়তনে এবং প্রতিষ্ঠানে জড়িত। এদের মধ্যে অনেকেই অন্য দেশে চলে গেছে এবং অনেকেই এদেশে আছে। তাদের মধ্যে স্বপন কোরায়া, রাজীব লোচন দাস, যীশুতোষ তালুকদার, প্রশান্ত দে, পার্থ মজুমদার, কিশোর কুমার শ্রেষ্ঠ, অনির্বান সরকার, প্রবীর কুমার দে এবং আরও অনেকে।

সর্বপরি আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি যে, পবিত্র দেকে জাতীয় পদক প্রাপ্তির ব্যবস্থা করে সম্মানিত করলে তার প্রতি প্রকৃত সম্মান দেখানো হবে। পবিত্র দে একজন প্রচারবিমুখ শিল্পী। শেষ বয়সে (বর্তমানে ৮৫ বৎসর চলছে) এসে যদি জাতীয় সম্মাননাটুকু পান তবে নিজেকে সারা জীবনের সংগীত সাধনার মূল্যায়নটুকু পাবেন, এটাই সকলের প্রত্যাশা।
পবিত্র দে এখন আর সংগীত জগতে নেই, বাড়ীতে দিন কাটাচ্ছেন। আমরা তার সুস্থ জীবন কামনা করে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি। প্রতিষ্ঠাতা : মিডিয়াস্কুল ডট এক্সওয়াইজেড।

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

ছুটি শেষে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর চালু

মো. রাশেদুজ্জামান রাশেদ, পঞ্চগড় প্রতিনিধি:...

খাগড়াছড়িতে ৪১ প্রার্থীর মনোনয়ন দাখিল

আবু রাসেল সুমন, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি:

দীর্ঘতম আলপনায় বিশ্বরেকর্ড গড়ার উদ্যোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক: এশিয়াটিক এক্সপে...

খাগড়াছড়িতে নানা আয়োজনে নববর্ষ উদযাপন

আবু রাসেল সুমন, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি:

শিবগঞ্জে তেলের গোডাউনে আগুন

জেলা প্রতিনিধি: বগুড়ার শিবগঞ্জে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় একটি তেলে...

বজ্রপাতে কিশোরের মৃত্যু

জেলা প্রতিনিধি : ঝালকাঠিতে বজ্রপাতে সিহাব জমাদ্দার (১৫) নামে...

মুন্সীগঞ্জে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ৭

জেলা প্রতিনিধি : মুন্সীগঞ্জে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আ...

বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যু

ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি: ময়মনসিংহের ভালুকায় বিদ্যুৎস্পৃষ...

কেএনএফের আরও ৯ সদস্য গ্রেফতার

জেলা প্রতিনিধি : বান্দরবানের রুমায় দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে...

বজ্রপাতে প্রাণ গেল ২ জনের 

জেলা প্রতিনিধি : মাদারীপুরের শিবচরে পৃথক বজ্রপাতে ২ জনের মৃত...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা