মতামত

শিক্ষকতা কেন ‘ঘটনাক্রমে’ পেশা

উমর ফারুক

কেএফসি’র প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল হারল্যান্ড ডেভিড স্ট্যান্ডার্সের শীর্ষে ওঠার গল্পটা আমরা জানি। একজন চা বিক্রেতার বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠার গল্পটা আমরা জানি। একজন তামাক ও দাস ব্যবসায়ীর বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের জাতির জনক হয়ে ওঠার গল্পটা আমরা জানি। হকার থেকে ধনী হয়ে ওঠা ওয়ারেন বাফেটের জীবনগল্পটা আমরা জানি। টুঙ্গিপাড়ার একজন খোকা বাবুর বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার গল্পটাও আমরা সবাই জানি। এগুলো নিশ্চিতভাবে সংগ্রামের গল্প, ঘটনাক্রমে ঘটে যাওয়া কোনও গল্প নয়।

একই সঙ্গে রাতারাতি ধনী হয়ে ওঠা অসংখ্য মানুষের গল্প আমাদের জানা। একজন ব্যবসায়ীর কোনও রকম রাজনৈতিক চর্চা ছাড়াই রাতারাতি জনপ্রতিনিধি হয়ে ওঠার গল্পটাও আমাদের জানা। সুযোগ বুঝে অনেকের মন্ত্রী হয়ে ওঠার গল্পটাও আমাদের অজানা নয়।

ঘটনাক্রমে ঘটে যাওয়া কদাচিৎ ঘটনা ছাড়া প্রায় সবটাই অপ্রত্যাশিত, অনভিপ্রেত ও নিন্দনীয়। এসব ঘটনা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কোনও সুফল বয়ে আনে না। একজন ব্যবসায়ী যদি রাতারাতি, ঘটনাক্রমে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠেন তাহলে তা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। একজন ডাক্তার যদি ঘটনাক্রমে ডাক্তারি পেশা বেছে নেন তাহলে তা স্বাস্থ্যসেবার জন্য ক্ষতিকর। একজন ইঞ্জিনিয়ার যদি ঘটনাক্রমে তার পেশা বেছে নিয়ে থাকেন তাহলেও তা ক্ষতিকর। একজন বিসিএস ক্যাডার যদি ঘটনাক্রমে পছন্দের তলানি থেকে তার শিক্ষকতা পেশা পেয়ে থাকেন তাহলেও তা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর যখন একজন শিক্ষক ঘটনাক্রমে ‘শিক্ষক’ হয়ে উঠছেন। শিক্ষকতা কোনও পেশা নয়, ব্রত। আর দশটি সাধারণ ব্রতর মতো নয়, একটি অনন্য ব্রত। রাষ্ট্র তাকে যথাযথ সম্মান দেবে না, সমাজ তাকে যথাযথ সম্মান দেবে না, তাকে বিনা বেতনে চাকরি করতে হবে, তাকে এমপিওভুক্তির জন্য লড়তে হবে, তাকে অভাবের সঙ্গে লড়তে হবে, এটা জেনেও তিনি শিক্ষকতাকে ব্রত হিসেবে বেছে নেবেন, এবং সেই ব্রত যথাযথভাবে পালন করে যাবেন, এজন্যই এর নাম শিক্ষকতা! কথাটায় যুক্তি যত কম, হাস্যকরও তত বেশি।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে একটা বড় অংশ ঘটনাচক্রে শিক্ষক। যারা হয়তো অন্য কোনও পেশায় না গিয়ে এই পেশায় এসেছেন। তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রশিক্ষিত শিক্ষক প্রয়োজন। একই অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রভাবশালীদের তদবিরে শিক্ষক নিয়োগ হয়। যোগ্যতা এখানে মূল ব্যাপার নয়। তিনি আরও বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে যারা, তারা ছাত্রনেতাদের কথায় ওঠেন-বসেন।

এই দুটো উদ্ধৃতি থেকে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মোটাদাগে কয়েকটা সমস্যা চিহ্নিত হয়। এক. ঘটনাক্রমে শিক্ষক। দুই. শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। তিন. প্রভাবশালীদের তদবিরে শিক্ষক নিয়োগ হয়। চার. শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতা মূল বিষয় নয়। পাঁচ. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রনেতারা ছড়ি ঘোরান। ছয়. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানরা ছাত্রনেতাদের কথায় ওঠেন ও বসেন।

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে দুই মন্ত্রী সাম্প্রতিক এমন মন্তব্যে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ভাবতে অবাক লাগছে, এই দীর্ঘ পথচলায় আজও আমরা শিক্ষাকে ‘ঘটনাক্রমে শিক্ষক’ লজ্জামুক্ত করতে পারলাম না। আজও আমরা প্রশিক্ষিত শিক্ষকের ব্যবস্থা করতে পারলাম না। শিক্ষক নিয়োগকে তদবিরমুক্ত করতে পারলাম না! এমন ছাত্রনেতা নির্বাচন করতে পারলাম না, যারা প্রতিষ্ঠান প্রধানকে ওঠাবেন না, বসাবেন না। এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানও নিয়োগ দিতে পারলাম না, যারা ছাত্রনেতাদের কথায় উঠবেন না, বসবেন না।

এখন প্রশ্ন জাগছে, এই ব্যর্থতা কার? রাষ্ট্রের, নাকি শিক্ষকদের? ব্যর্থতার দায় নিয়ে যদি বিতর্কে না জড়াই তাহলে দুই মন্ত্রীর এমন মন্তব্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য নতুন আলোর সূচনা করতে পারে। কারণ, এই প্রথম আমরা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল সংকটকে চিহ্নিত করতে পেরেছি। সমস্যা চিহ্নিত করতে পেরেছি। সমস্যা স্বীকার করে নিয়েছি। ফলে আন্তরিকতা থাকলে এখন শিক্ষা ব্যবস্থাকে সংকটমুক্ত করা সম্ভব। মূলত এই মন্তব্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের মুক্তির এক দুরন্ত সম্ভাবনা।

শিক্ষার মান বিশ্লেষণ বলছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের শিক্ষার মান ২ দশমিক ৮ শতাংশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কায় শিক্ষার মান ২০ দশমিক ৮ শতাংশ এবং পাকিস্তানের শিক্ষার মান ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু কেন আমাদের শিক্ষার মানের এই বেহাল দশা? তাহলে কি ঘটনাক্রমে শিক্ষকদের জন্যই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এই ভয়াবহতা নেমে এসেছে? কিন্তু কেন শিক্ষকতা আমাদের দেশে পছন্দ না হয়ে ঘটনাক্রমে ঘটে যাওয়া পেশা হলো?

উন্নত দেশের শিক্ষকদের সঙ্গে আমাদের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার পার্থক্য কতটা?

ক’বছর আগেও আমাদের দেশে শিক্ষকতা পেশার জন্য প্রকাশ্য ঘুষ প্রচলন ছিল। সবাই জানতো কিন্তু কেউ কিছু বলতো না। এর নাম ছিল অনুদান। ক’টাকা প্রতিষ্ঠানের খাতে জমা হতো, বাকিটা হতো ভাগবাটোয়ারা। তখন কয়েক লক্ষ টাকা ও একটি ফোনে জুটে যেত শিক্ষকতা পেশা। যাদের কোনও চাকরি হয়নি, বয়স শেষ অথবা প্রায় শেষ– তিনি নেতাদের ধরে কিছু টাকা অনুদান দিয়ে এলাকার স্কুল অথবা কলেজে শিক্ষকতায় যোগদান করতেন।

কী নির্মম একটা গল্প! অপেক্ষাকৃত কম মেধার ও কখনও কখনও বখাটে, সন্ত্রাসীদের হাতে আমরা তুলে দিতাম আমাদের প্রজন্ম বিনির্মাণের দায়িত্ব। একবার ভাবুন তো, একটি শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য কি আর কোনও পদক্ষেপ দরকার আছে? এখন এই সুযোগ কমেছে। সময়টা এখন খানিকটা বদলে গেছে। এখন নিয়োগ হয় এনটিআরসি’র মাধ্যমে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য কিছু ক্ষেত্র এখনও অযোগ্য শিক্ষকদের নিয়োগের দ্বার পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।

বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে শিক্ষকতা পছন্দের পেশা নয়, বরং ঘটনাক্রমে পেশা। সাধারণত কেউ এই পেশায় আসতে চান না। সে জন্য একসময় আমরা সবচেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন অনেক মানুষকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োগ দিয়েছি। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টো। কিন্তু কেন কেউ শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান না? খুব সোজাসাপ্টা কথা হলো, এই পেশায় আর্থিক সুযোগ-সুবিধা অত্যন্ত কম। কম মানে শুধু কম নয়, অতি নগণ্য। আমরা এক দুর্ভাগা জাতি, এজন্যই হয়তো শিক্ষকতা পেশার জন্য বরাদ্দ রেখেছি সর্বনিম্ন।

পেশাগত ক্ষেত্রে আমাদের সর্বোচ্চ বরাদ্দ ক্যাডার পেশায়। তাও আবার সব ক্যাডারে নয়, কয়েকটি পেশায়। যেখানেও শিক্ষকতা পেশা অবহেলিত। ফলে প্রতিদিন মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, যা আমাদের পুরো রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থাকে এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

গবেষণা বলছে, আমাদের ৬৬ শতাংশ স্নাতক পাস মানুষ কর্মহীন। এটা দুঃখজনক। যদি আমরা মেধাবী প্রজন্ম তৈরি করতে চাই, যদি আমরা শুধু মেধাবী বিসিএস ক্যাডারও তৈরি করতে চাই, যদি শিক্ষকতাকে পছন্দের তালিকায় আনতে চাই, তবে সবার আগে এই পেশার সামাজিক ও আর্থিক মর্যাদা বাড়াতে হবে। নানান সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে এই পেশাকে গুরুত্বপূর্ণ, লোভনীয় ও গ্রহণযোগ্য করার দায়িত্ব রাষ্ট্ররই। একই সঙ্গে শিক্ষকতা পেশা নির্বাচনকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। তাহলেই প্রথম পছন্দ হিসেবে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় সম্পৃক্ত হবে। তখন আর কেউ ঘটনাক্রমে শিক্ষক হবে না। শেষ পছন্দ হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নেনে না। বেছে নেবেন প্রথম পছন্দ হিসেবে। তাহলেই বাড়বে শিক্ষকের মান, বাড়বে শিক্ষার মান। মুক্তি পাবে আমাদের শিক্ষা।

লেখক: শিক্ষক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

ই-মেইল: [email protected]

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

সম্মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নির্বাচন সম্পন্ন

কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী (ফরিদপুর) : ফরিদপুর জেলার সদর ইউনিয়...

ভোলায় অনুষ্ঠিত হলো প্রাণী প্রদর্শনী মেলা

ভোলা প্রতিনিধি: ‘প্রাণিসম্পদে ভরবো দেশ, গড়বো স্মার্ট ব...

সম্মিলনী বিদ্যালয়ের সভাপতি ফিরোজ আহমেদ

কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী (ফরিদপুর) : ফরিদপুর জেলার সদর ইউনিয়...

বাংলাদেশ স্কাউট দিবস ২০২৪ পালিত

নিজস্ব প্রতিবেদক : আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে অনুষ্...

ভাসানচরে এক রোহিঙ্গাকে গলা কেটে হত্যা

নোয়াখালী প্রতিনিধি : নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যা...

ভাসানচরে এক রোহিঙ্গাকে গলা কেটে হত্যা

নোয়াখালী প্রতিনিধি : নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যা...

আলিয়ঁসে সুরঞ্জনার ‘সিবীত কোলাজ’ প্রদর্শনী

সাজু আহমেদ: রাজধানী ঢাকায় চিত্র প...

গরমে ত্বক সতেজ রাখুন

লাইফস্টাইল ডেস্ক : গরমে মধ্যে ত্বক হয়ে পড়ে নিষ্প্রাণ। তাই এই...

চিয়া সিডের পুষ্টি গুন

লাইফস্টাইল ডেস্ক : চিয়া বীজ হল সালভিয়া হিসপানিকা ভোজ্য বীজ...

সোনার দামে নতুন রেকর্ড

নিজস্ব প্রতিবেদক: সোনার দাম আবারও বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে বাং...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা