কবির য়াহমদ
১১ জন সাংবাদিক নেতার ব্যাংক হিসাব তলব করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এই খবরে অনেকে নড়েচড়ে বসেছেন। কেউ কেউ ‘বিস্মিত’ এমন খবরে। এই বিস্ময়ের কী কারণ? সাংবাদিক, তার ওপর সাংবাদিক নেতা বলে? সাংবাদিক নেতা বলে কি ব্যাংক হিসাব সম্পর্কিত তথ্য চাইতে পারে না কোনো প্রতিষ্ঠান, সংস্থা?
পারে, অবশ্যই পারে। যেকোনো ব্যক্তির ব্যাংকের লেনদেন ও স্থিতি সম্পর্কিত তথ্য চাওয়ার ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চাইতে পারে, বিএফআইইউ চাইতে পারে। এই লেনদেন ও স্থিতিতে সন্দেহজনক কিছু থাকলে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এখানে আপত্তির কিছু থাকার কথা নয়। কোনো পেশার কেউ জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নয়, সাংবাদিকেরাও নয়। এটাকে তাই স্বাভাবিকভাবেই দেখা যেতে পারে।
এই হিসাব তলবের পর সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের কেউ কেউ বলছেন এতে ভুল বার্তা যেতে পারে মানুষের মাঝে। সন্দেহ সৃষ্টি হয় এমন একটা বার্তা যে যায়নি এমন না। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে চাওয়া বিএফআইইউ’র এই চিঠি কি ‘গোপনীয়’ থাকার কথা না! গোপনীয় বলে দৃশ্যমান হয়নি, তাই হিসাব তলব সম্পর্কিত এই খবর মানুষের মুখে-মুখে; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এরমাধ্যমে আরও অনেক ঘটনার মত কিছু মানুষকে কি মিডিয়া ট্রায়ালে আগেভাগেই দোষী বানিয়ে দিচ্ছে না?
এমন না যে কারও ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া মানেই সে সন্দেহজনক লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত কিংবা সন্দেহজনক স্থিতি রয়েছে তার হিসাবে। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ ও সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ এর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট দেশের যেকোনো নাগরিকের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিতে পারে। ‘মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কার্যে অর্থায়ন প্রতিরোধে তফসিলি ব্যাংক কর্তৃক অনুসরণীয় বিধানসমূহ সম্পর্কিত মাস্টার সার্কুলার’, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৪ অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর অন্য অনেক বিষয়ে নজরদারির পাশাপাশি নগদ লেনদেন রিপোর্ট (সিটিআর) ও সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্ট (এসটিআর) প্রতিমাসে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রেরণ করে থাকে। নগদ লেনদেনের ক্ষেত্রে মাসের কোন কোনোদিন নির্দিষ্ট কোন হিসাবে দশ লক্ষ টাকা বা তদূর্ধ্ব এক বা একাধিক লেনদেনের মাধ্যমে সম্পাদিত হলে ব্যাংক এই প্রতিবেদন পাঠায়। এই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বিএফআইইউ পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়। এরবাইরে যদি সরকারি কোনো সংস্থা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের তথ্য জানতে চায় তখন বিএফআইইউ তফসিলি ব্যাংকগুলোর কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বিএফআইইউ-এর প্রধান হলেও প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব আইনে পরিচালিত হয়। অবৈধ ব্যাংক লেনদেনের পাশাপাশি অর্থপাচার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়নের বিষয়ও নজরদারি করে থাকে বিএফআইইউ।
অদ্য যে ১১ জন সাংবাদিক নেতার ব্যাংক হিসাবের তথ্য বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) চাওয়ায় সংশ্লিষ্টরা হয়ত বিস্মিত, তারা হয়ত ভাবছেন তাদের ব্যাংক হিসাবে বড়ধরনের তেমন কোন স্থিতি নেই, লেনদেন হয়নি, সন্দেহজনক ভাবা যেতে পারে এমন লেনদেনও হয়নি। তাদের বিস্ময়ের কারণ হয়ত সরল বিশ্বাসের, হয়ত ব্যাংক হিসাবের প্রকৃত তথ্য সম্পর্কে অবগত বলে। তবে এরবাইরে স্রেফ ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়ার সংবাদ প্রকাশের পর তাদেরকে নিয়ে অহেতুক সন্দেহ করার যৌক্তিক কারণ দেখি না। কারণ কেবল লেনদেন ও স্থিতিই কারও ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়ার একমাত্র কারণ নাও হতে পারে, এখানে সরকারি কোন প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ থাকলেও থাকতে পারে। এছাড়াও নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে বিএফআইইউ যেকোনো মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য তলব করতেও পারে। আর তথ্য চাওয়া মানেই কেউ দোষী হয়েও যায় না।
বিএফআইইউ যাদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে শিরোনাম হয়েছে তাদের সকলেই সাংবাদিক নেতা। জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি আব্দুল কাদের গণি চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মো. শহিদুল ইসলাম। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি এম আব্দুল্লাহ ও মহাসচিব নুরুল আমিন রোকন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি মোল্লা জালাল ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আব্দুল মজিদ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি মোরসালীন নোমানী ও সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান খান। সাংবাদিকদের জন্যে দলীয় বিভাজন প্রকাশ্য না থাকার কথা থাকলেও আমাদের সাংবাদিক নেতা ও সংগঠনের মধ্যে এই বিভাজন আছে, এবং বিভাজনের সূত্রে বলা যায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলীয় সাংবাদিক নেতা এই তালিকায় আছেন। দলমত নির্বিশেষে প্রায় সকল সাংবাদিক সংগঠনের নেতাদের একসঙ্গে ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া কি তবে বিএফআইইউর স্রেফ রুটিনওয়ার্ক, সন্দেহজনক লেনদেন সম্পর্কিত? সন্দেহের মধ্যেও উদ্দেশ্য বিষয়ক সন্দেহ উঁকি কি দিচ্ছে না? ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ নামের যে অলিখিত যে রীতি গণমাধ্যমে চোরাস্রোতের মত বয়ে যায় এটা কি একে শক্তিশালী করবে না? চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে এগুলো আদতে প্রশ্ন, শঙ্কা; উত্তর, সমাধান এখনই পাওয়া যাবে না।
অন্য অনেকের মত সাংবাদিকদের ব্যাংক হিসাব তলব নতুন কিছু নয়। এরআগে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সময়ে একাধিক সাংবাদিক, লেখকের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। এই তালিকায় আছেন দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম, বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক পীর হাবিবুর রহমান, প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম। এছাড়াও আরও অনেক সাংবাদিকের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়াও হয়েছে নানা সময়ে। তবে এই ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়ার মাধ্যমেই তাদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং সম্পাদিত যে হয়েছে এমনটা প্রমাণিত হয়নি। বলা যায়, অনেক কিছুই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের রুটিনওয়ার্কের মধ্যেই ছিল। সম্প্রতি সচিবালয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম নিগ্রহের শিকার হওয়ার পর বিএফআইইউ তার ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে তফসিলি ব্যাংকগুলোতে চিঠি পাঠিয়েছিল। এটার একটা কারণ হয়ত তাকে নিয়ে হঠাৎ করে আলোচনা শুরু, যেখানে কোন আর্থিক অসঙ্গতির যোগ আছে কিনা সেটাও খুঁজে বের করা। অদ্যকার ১১ জন সাংবাদিক নেতার তথ্য একসঙ্গে চাওয়ার মধ্যেও সেই সন্দেহ থাকতেও পারে, যা নিশ্চিত করে এখনই বলা যাচ্ছে না; অন্তত সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের আগে।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট তফসিলি ব্যাংকগুলোর কাছে ১১ জন সাংবাদিক নেতার ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়েছে। তারা এই তথ্য দিতে বাধ্য। এখানে উৎস থেকে তথ্যের যে গোপনীয়তার কথা মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কার্যে অর্থায়ন প্রতিরোধে তফসিলি ব্যাংক কর্তৃক অনুসরণীয় বিধানসমূহ সম্পর্কিত মাস্টার সার্কুলারের সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হয়েছে সেটা প্রতিপালিত হয় কিনা এটাও দেখার বিষয়। কারণ অনেক তথ্য উৎস ফাঁস হতে দেখি আমরা। বিএফআইইউ তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে তথ্য পেয়ে যাচাইবাছাই শেষে করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে কিন্তু উৎস থেকে এই তথ্য ফাঁস হলে এটা নিয়ে আরেকটা মিডিয়া ট্রায়ালের জন্ম নেবে, যার কোন সমাধা আদতে নেই।
১১ জন সাংবাদিক নেতার ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়ার পর এনিয়ে অতি-প্রতিক্রিয়া দেখানোর কিছু যেমন নেই, এটা নিয়েও মিডিয়া ট্রায়ালে কাউকে একতরফা দোষারোপেরও কিছু নেই। শঙ্কার কথা তারা নিজেদের পেশাগত ক্ষেত্রে যেমন প্রশ্নের মুখে পড়েছেন, তেমনি প্রশ্নের মুখে পড়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। তাদের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন ও স্থিতিতে সন্দেহজনক কিছু থাকুক কিংবা না-ই থাকুক সেটা প্রমাণসাপেক্ষ তবে এখন থেকেই এ বিষয়ে যে মিডিয়া ট্রায়াল হচ্ছে এতে যা হচ্ছে তাকে বলা যায় ‘রেপুটেশনাল লস’। ফাইন্যান্সিয়াল লসের প্রতিকার আছে, কিন্তু রেপুটেশনাল লসের কোনো প্রতিকার নেই। এই ক্ষতির মূল্য চুকাতে হয় একতরফা ও ব্যক্তিগতভাবেই।
লেখকের পরিচয়ঃ কবির য়াহমদ।কবি, লেখক। প্রধান সম্পাদক, সিলেটটুডে২৪.কম।
সান নিউজ/এমএইচ