বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শর্ত দিয়ে আন্দোলনে নামার হুমকি দিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি।
যখন অন্তবর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ভোটের সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণা দিয়ে সেই লক্ষ্যে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তখনও নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ, সংশয় এবং অনেক প্রশ্ন উঠছে।
কারণ সংস্কার প্রস্তাবের জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে শর্ত দিয়ে জামায়াত, এনসিপি এখন বিএনপির পাল্টা বা বিপরীত অবস্থান নিয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য, বিভক্তি বাড়ছে।
জামায়াত ও এনসিপির নেতারা বলছেন, সংস্কার ও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচারের বিষয় পাশ কাটিয়ে একটি 'সাজানো' নির্বাচন করা হচ্ছে।প্রশ্ন উঠছে, জামায়াত ও এনসিপি এখন যেসব শর্ত সামনে এনে আন্দোলনে নামার কথা বলছে, তারা তাদের শর্ত বা দাবি আদায়ে কতদূর যেতে পারে, তারা কি নির্বাচন বর্জনের মতো অবস্থানে যেতে পারে?
এই দলগুলোর শর্ত বিএনপিকে কী ধরনের চাপে ফেলতে পারে, এমন প্রশ্নেও চলছে নানা আলোচনা।
নির্বাচনের সময় নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ও এনসিপির মতপার্থক্য ছিল শুরু থেকেই। বিএনপি দ্রুত নির্বাচন দাবি করে আসছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন করার কথা বলে আসছিলেন।
সে সময় নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের সঙ্গেও বিএনপির সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি হয়েছিল। এক পর্যায়ে বিএনপি এ বছরের ডিসেম্বরেই নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ তৈরির পরিকল্পনা করছিল। সেই পরিস্থিতিতে অনেকটা আকস্মিকভাবে নির্বাচন নিয়ে সরকারের অবস্থান বদলের পেছনে ছিল লন্ডন বৈঠক।
প্রধান উপদেষ্টা তার লন্ডন সফরে গত ১৩ই জুন সেখানে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়। এই বিবৃতিতে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের একমত হওয়ার কথা বলা হয়েছিল।
লন্ডন বৈঠক এবং তারপর একটি দলের নেতার সঙ্গে নির্বাচনের ব্যাপারে যৌথ বিবৃতি নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিল জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন দল।
শেষ পর্যন্ত ফেব্রুয়ারিতেই রোজার আগে নির্বাচনের ঘোষণা আসার পর তাতে জামায়াত, এনসিপি বা কোনো দলই আপত্তি করেনি।
তবে জামায়াত, এনসিপি নির্বাচনের আগেই সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের শর্ত বা দাবি তুলেছে। এমনকি জাতীয় সংসদের চলমান নির্বাচনের পদ্ধতি পাল্টিয়ে ভোটের আনুপাতিক হার বা পিআর পদ্ধতি চালু করার দাবিকেও সামনে আনছে জামায়াত।
যদিও জামায়াত ও এনসিপি নেতারা বলছেন, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটাতে সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা উচিত।
কিন্তু মনে হয় না-সরকার এখনই আবার আলোচনার পথে হাঁটবে। অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচনের সময় ঘোষণার পর এখন নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে।
জামায়াত ও এনসিপির কমন দাবি হচ্ছে, সংবিধানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে জুলাই সনদ তৈরি করছে, সেই সনদ বাস্তবায়নের আইনগত ভিত্তি দিতে হবে। এবং সনদ বাস্তবায়ন করে তার ভিত্তিতে নির্বাচনে যেতে হবে।
এখানে বিএনপির অবস্থান কিন্তু ভিন্ন। তারা চায়, নির্বাচন সম্পর্কিত বিষয়গুলো ছাড়া সংবিধানসহ অন্য বিষয়ে সংস্কার নির্বাচিত সংসদ করবে।
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্রেও সনদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব নির্বাচিত সংসদকে দেওয়া হয়েছে।
আর এতে আপত্তি জামায়াত ও এনসিপির। তারা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা নির্বাচনের আগে এখন থেকেই সব দলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির দাবি তুলেছে।
উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ, সংসদের উভয় কক্ষে ভোটের আনুপাতিক হার বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিকে আবারও জোরালোভাবে সামনে এনেছে জামায়াত। এসব দাবিতে তাদের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনসহ ইসলামপন্থী বিভিন্ন দলও রয়েছে।এই দলগুলো রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়ার কথাও বলছে।
তবে বিএনপি শুরু থেকেই পিআর পদ্ধতিরও বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। দলটির নেতারা বলছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকগুলোতে একটিমাত্র দল ইসলামী আন্দোলন পিআর পদ্ধতির কথা তুলেছিল। এছাড়া এটি আলোচ্যসূচিতেও ছিল না।এখন ওই দাবি আবার সামনে আনায় এর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিএনপি নেতারা।বিভিন্ন শর্ত তুলে আন্দোলনের হুমকি দেওয়ার বিষয়কে নির্বাচন ভণ্ডুল করার কৌশল বলেও অভিযোগ করা হচ্ছে।
তবে জামায়াতে নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মা. তাহের বলেছেন, "অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংস্কারের সনদ আগে বাস্তবায়ন করতে হবে।যারা এতে বাধা তৈরি করছে, তারাই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়,"
নির্বাচন কমিশন অবশ্য এরইমধ্যে বলেছে যে, তারা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। সেখানে নির্বাচনের তফসিল ও পরিবেশ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু সংবিধান সংস্কার বা এর বাস্তবায়নের দাবিদফা নিয়ে আলোচনা করার ফোরাম সেটি নয়।
অন্যদিকে, বিশ্লেষকদের পাশাপাশি রাজনীতিকদেরও অনেকে বলছেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করার ব্যাপারে সরকারের ভেতরেই একটি পক্ষের জোরালো আপত্তি ছিল। সেটিও নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ, সংশয়ের পেছনে অন্যতম একটি কারণ।
নির্বাচনের আগে কোনো দল যদি দাবিদফা নিয়ে রাজপথে কর্মসূচি দেয়, সেটা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করতে পারে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
জামায়াত ও এনসিপি যদিও বলছে, ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচনে তাদের আপত্তি নেই। কিন্তু নির্বাচনের আগে সংস্কারের জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দাবি থেকে তারা সরবেন না।
অন্যদিকে, বিএনপিও তাদের অবস্থানে কোনো ছাড় দেবে না। ফলে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও বাড়তে পারে বলে বিশ্লেষকদের অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
তারা বলছেন, এখন গণতন্ত্রে ফিরতে ভোটের প্রয়োজন। কিন্তু কোনো পক্ষের বা কোনো দলের কারণে নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়লে এর দায় তাদের ওপরই বর্তাবে। ফলে কোনো রাজনৈতিক দল সেই দায় নিতে চাইবে না।