সারাদেশ

পাথর তোলায় রাজনৈতিক দলের ‘ঐকমত্য’, পরে লুট

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধ থাকলেও পাথর উত্তোলনে রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় নেতাদের মধ্যে ঐকমত্য ছিল। কারণ, পাথর উত্তোলন, পরিবহন, মজুত রাখা, ভাঙা ও বিক্রির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।

স্থানীয় প্রশাসনও পাথর উত্তোলনের পক্ষে সম্প্রতি মত দিয়েছে। কিন্তু সরকার সাড়া দেয়নি। পরে হয় শুরু গণলুট। লুটের জন্য স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদেরই দায়ী করছেন পরিবেশকর্মীরা। প্রথম আলোর অনুসন্ধানেও তাঁদের নাম এসেছে। কেউ কেউ আত্মগোপনেও চলে গেছেন।

পরিবেশবাদী সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সিলেটের সদস্যসচিব আবদুল করিম চৌধুরী বলেন, পাথর লুট ঠেকাতে প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে। এর সঙ্গে প্রকাশ্যে ও গোপনে জড়িত রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতারা। তিনি বলেন, বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের নেতারা যেভাবে সভা-সমাবেশে কোয়ারি চালুর পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন, এটা দুঃখজনক। পাথর লুটের দায় এসব নেতা কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।

সারা দেশে ৫১টি কোয়ারি (পাথর, বালু ইত্যাদি উত্তোলনের নির্দিষ্ট স্থান) রয়েছে। এর মধ্যে সিলেটের কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরে রয়েছে আটটি পাথর কোয়ারি। এর বাইরে সিলেটে আরও ১০টি জায়গায় পাথর রয়েছে। যেমন সাদাপাথর, জাফলং, বিছনাকান্দি ও উৎমাছড়া। এসব জায়গা পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।

পাথর আসে সীমান্তের ওপারে ভারতের পাহাড়ি নদী থেকে। বহু বছর ধরে পানির স্রোতের সঙ্গে এসব পাথর এসে কোয়ারি তৈরি হয়েছে। ২০২০ সালের আগে সংরক্ষিত এলাকা বাদে সিলেটের আটটি কোয়ারি ইজারা দিয়ে পাথর উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া হতো। তবে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতির কারণে ২০২০ সালের পর আর পাথর কোয়ারি ইজারা দেওয়া হয়নি।

বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন সহ বিভিন্ন দলের নেতারা যেভাবে সভা-সমাবেশে কোয়ারি চালুর পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন, এটা দুঃখজনক। পাথর লুটের দায় এসব নেতা কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।উল্লেখ্য, জাফলং (জাফলং-ডাউকি নদী) পরিবেশ অধিদপ্তর ঘোষিত প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ)। জাফলংসহ অন্যান্য এলাকা থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করা হলে পরিবেশ আইনে জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। আবার খনিজ সম্পদ (নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন) আইনেও এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

দেশের নির্মাণ খাতে পাথরের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদেশ থেকে প্রায় ৯৫ লাখ মেট্রিক টন পাথর আমদানি করেছেন ব্যবসায়ীরা, যার দাম দেখানো হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। দেশের নির্মাণ খাতে পাথরের চাহিদার বড় অংশ আমদানি করে মেটানো হয়। বাকিটা চাহিদার বেশির ভাগ পূরণ হয় দিনাজপুরের মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্প ও সিলেট থেকে উত্তোলন করা পাথর দিয়ে।সিলেটে প্রতি ঘনফুট পাথর আকার ও ধরনভেদে ৬০ থেকে ১৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়। লুটপাট করা পাথরের দাম প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বলে ধারণা করছেন কেউ কেউ। তবে কোনো হিসাব বা প্রাক্কলন পাওয়া যায়নি।

সিলেটের ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক দলের নেতারা সব সময় পাথর উত্তোলনের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন। বিগত পাঁচ বছরে তাঁরা নানাভাবে পাথর কোয়ারি ইজারা আবার চালুর চেষ্টা করেছেন; কিন্তু সরকার অনুমতি দেয়নি। গত ২৭ এপ্রিল দেশের ৫১টির মধ্যে ১৭টি কোয়ারির ইজারা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে আটটি সিলেটের। তবে সংরক্ষিত এলাকা, পর্যটনকেন্দ্র ও কোয়ারিগুলোর পাথর একসঙ্গে লুট করে নেওয়া ঠেকানো যায়নি।

সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে গত ২৪ জুন জেলা পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ব্যানারে কোয়ারি ইজারার দাবিতে মানববন্ধন হয়। এতে যোগ দিয়ে একাত্মতা জানান সিলেটের বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শীর্ষ ছয় নেতা। তাঁরা হলেন সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী ও সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর সিলেট মহানগরের আমির মো. ফখরুল ইসলাম ও জেলার সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিলেট জেলার প্রধান সমন্বয়কারী নাজিম উদ্দিন ও মহানগরের প্রধান সমন্বয়কারী আবু সাদেক মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম চৌধুরী।
এর বাইরে বিভিন্ন সময় কোয়ারি চালুর পক্ষে নিজেদের অবস্থানের কথা জানিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টিসহ বিভিন্ন দলের কয়েকজন নেতা।

সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবীও গত ৯ জুলাই এক সভায় পাথর উত্তোলনের পক্ষে মত দেন। সিলেটের পাথরসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ ও সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে আয়োজিত এক বৈঠকে তিনি বলেন, ‘সারা দেশে পাথর উত্তোলন করা গেলে সিলেটে যাবে না কেন? এর সঙ্গে মানুষের জীবন ও জীবিকা জড়িত।’

সিলেটের পরিবেশকর্মীরা বলেছেন, রাজনীতিবিদদের এই অবস্থান পাথর লুটে উৎসাহ দিয়েছে। লুটপাটের পর নেতারা অবশ্য বলছেন, তাঁরা লুটের পক্ষে নন।

সিলেট জেলা বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ্ সিদ্দিকী বলেন, ‘কোয়ারি চালুর দাবির সঙ্গে লুটের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কোয়ারি চালুর দাবি করেছি নীতিমালার ভিত্তিতে।’ তিনি বলেন, সাংগঠনিকভাবে বিএনপি লুটপাটকারী কাউকে প্রশ্রয় দেয় না।

সিলেট জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীনের বক্তব্যও একই রকম। তিনি বলেন, ‘আমাদের বক্তব্য সুস্পষ্ট, প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণে এই জাতীয় সম্পদ (সাদাপাথর) ধ্বংস হলো। প্রশাসনকে বারবার বলার পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তারা জানে, কিন্তু ব্যবস্থা নেয়নি।’ তিনি বলেন, ‘কোয়ারি চালুর দাবি আমরা যৌক্তিক কারণেই করেছি। আমরা পরিবেশসম্মতভাবে সনাতন পদ্ধতিতে কোয়ারি চালুর দাবি জানিয়েছি।’

এনসিপি সিলেট জেলার প্রধান সমন্বয়কারী নাজিম উদ্দিন শাহানের দাবি, পাথর কোয়ারির কিছু সংগঠন মানববন্ধনে সব দলকে দাওয়াত দেওয়া হয়। এ কারণে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। তবে যে লুটপাট হয়েছে, সেটাকে তাঁরা সমর্থন করেন না।
পাথর লুট করে অনেকে বিপুল টাকার মালিক হলেও বিপাকে পড়েছেন সাদাপাথর এলাকার পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীরা। সেখানে দৈনিক ৪ থেকে ৫ হাজার পর্যটক যেতেন। ছুটির দিনগুলোতে এ সংখ্যা আরও বেশি হতো। দোকানগুলোতে ভালো কেনাবেচা হতো। এখন সেটা কমে গেছে।

সীমান্তের ওপারের পাহাড় থেকে পাথর এসে আবার সাদাপাথরে জমা হতে কত দিন লাগবে, সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাতারাতি এটা হবে না।সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক মুশতাক আহমদ বলেন, অল্প সময়ে সব পাথর নিয়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ভারসাম্যহীনতা তৈরি হবে। ভাঙন বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। আর পর্যটকেরা তো ঘোলা পানি আর বালু দেখতে আসবেন না। তিনি আরও বলেন, পানির নিচের অংশটুকুতে হয়তো ধীরে ধীরে পাথর আসতে পারে। কিন্তু সাদাপাথরের পর্যটনকেন্দ্রে পাথর আগের অবস্থায় পৌঁছাতে অনেক সময় লাগবে।

সাননিউজ/এসএ

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

দেব–শুভশ্রীর ছবি নিয়ে তোলপাড়

দীর্ঘ বিরতির পর সাবেক প্রেমিক জুটি দেব ও শুভশ্রী পর্দায়। কৌশিক গাঙ্গুলীর &lsq...

নির্বাচনের রোডম্যাপ আগামী সপ্তাহে, আশা ইসির

আগামী সপ্তাহে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ (পথনকশা) ঘোষণা করতে পারব...

ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক কাল

ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে আলোচনা করতে আগামীকাল শুক্রবার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ব...

দুই দিনের ব্যবধানে ঢাকায় আসছেন পাকিস্তানের দুই মন্ত্রী

মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে ঢাকায় আসছেন পাকিস্তানের দুই মন্ত্রী। পাকিস্তানের বাণ...

তিস্তার পানি বিপৎসীমার উপরে, ৫ উপজেলার বহু মানুষ পানিবন্দি

টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার উপর দিয়ে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা