মতামত

সাংবাদিকদের ব্যাংক হিসেব প্রকাশ করা হোক

প্রভাষ আমিন

আগে সমাজে সাংবাদিকদের উচ্চ মর্যাদা ছিলো। সাংবাদিকদের সবাই ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা মেশানো সমীহ করতেন। গত কয়েক বছরে সামাজিক পারসেপশনটা পাল্টে গেছে। এখনও সাধারণ মানুষ সাংবাদিকদের সমীহ করে বটে, তবে তাতে ভালোবাসা-শ্রদ্ধার চেয়ে ভয় মেশানো থাকে বেশি। মনে করা হয়, সাংবাদিকদের মানুষের ক্ষতি করার ক্ষমতা আছে। এ কারণে অনেক বাড়িওয়ালা সাংবাদিকদের বাড়ি ভাড়া দিতে চান না।

সাধারণভাবে সাংবাদিকদের নৈতিকতা এবং সততা প্রশ্নবিদ্ধ। সাধারণ মানুষ মনে করে, সাংবাদিকেরা বেতনকড়ি পায় না। তারা ধান্ধাবাজি বা চাঁদাবাজি করেন। তাদের ধারণা, সাংবাদিকরা সরকারের দালালি করে এবং বিনিময়ে সরকার তাদের সুযোগ-সুবিধা দেয়। প্রথম কথা হলো, বাংলাদেশের সব খাতই এখন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত।

সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে। সাংবাদিকরাও এই সমাজেই বাস করে। তাই সাংবাদিকদের কারো কারো আয়ের সাথে ব্যয় নাও মিলতে পারে। বাড়ি, গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ, শান-শওকত দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না; শুধু সাংবাদিকতায় সম্ভব নয় এতকিছু। তবে সাংবাদিকদের সম্পর্কে সামাজিক পারসেপশনে একটা বড় রকমের গলদ আছে। মানুষের সাথে কথা বললেই মনে হয়, সৎ সাংবাদিক মানেই তিনি বস্তিতে থাকবেন, রিকশায় চড়বেন। কদিন আগে আমি অফিসে যাওয়ার সময় মেসেঞ্জারে একজন কল দিলেন। ধরে বললাম, আমি গাড়ি চালাচ্ছি, পরে ফোন দেবো। আমি গাড়ি চালাচ্ছি শুনে ভদ্রলোক যেন আকাশ থেকে পরলেন।

তার প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হলো, গাড়িটি আমি সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কোনো শোরুম থেকে এইমাত্র ডাকাতি করে এনেছি। অথচ গত ২০ বছর ধরেই আমি অফিস থেকে চালকসহ সার্বক্ষণিক গাড়ি সুবিধা পেয়ে আসছি। শুধু আমি নই, ঢাকায় এমন শখানেক সাংবাদিক আছেন, যারা অফিসের দেয়া গাড়ি ব্যবহার করেন। লাখ টাকার ওপর বেতন পান, এমন সাংবাদিকের সংখ্যাও অনেক। কোনো সাংবাদিকের গাড়ি-বাড়ি আছে শুনলেই, তাকে অসৎ মনে করার কোনো কারণ নেই। ২৫/৩০ বছর ভালো প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকতা করলে, একটু হিসাব করে চললে; ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে একটা ফ্ল্যাট বা গাড়ি কেনা সম্ভব।

সাংবাদিকদের সম্পর্কে এই ভুল পারসেপশনে সুকৌশলে ঘি ঢেলেছে সরকার। সম্প্রতি সরকারের একটি সংস্থার চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বাংলাদেশের ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়ে ১১ সাংবাদিক নেতার বিস্তারিত হিসাব চেয়েছে। চিঠিতে বিস্তারিত হিসাব মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগে পাঠাতে বলা হয়েছে। বিএফআইইউ প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটি এবং দুইভাগে বিভক্ত বিএফইউজে এবং ডিইউজের শীর্ষনেতাদের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে। সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন এ সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার দাবি জানাচ্ছেন। তবে যাদের হিসাব চাওয়া হয়েছে, তাদের অধিকাংশই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। যদিও এখন তারা সে অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। সবাই এখন এর বিরোধিতাই করছেন।

আমি অবশ্য সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলবের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগতই জানাই। সাংবাদিকদের প্রতিক্রিয়া দেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, সাংবাদিকদের হিসাব চাইলে আপত্তি কোথায়, তাদের হিসাব দিতে সমস্যা কোথায়, তারা কি আইনের উর্ধ্বে? আমি তাদের সাথে একমত। সাংবাদিকরা কখনোই আইনের উর্ধ্বে নন। সরকার চাইলে যে কারো হিসাব তলব করতে পারে, আয়-ব্যয় না মিললে মামলা করতে পারে। আর বিএফআইইউ সরাসরি নেতাদের কাছে হিসাব চায়নি, চেয়েছে ব্যাংকগুলোর কাছে। তাই এখানে নেতাদের চাওয়া না চাওয়া, হিসাব দেয়া না দেয়ার কোনো বিষয় নেই।

কিন্তু সমস্যা হয়েছে অন্যখানে। স্বাগত জানালেও বিএফআইইউ এর এই সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য নিয়ে আমার সংশয় আছে। প্রথম সংশয় হলো, ১১ সাংবাদিক নেতার ব্যাংক হিসাব তলব সমাজে সাংবাদিকদের সম্পর্কে নেতিবাচক পারসেপশনে প্রায় বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তি দেবে। লোকজন বলাবলি করছে, আগেই বলেছিলাম, সাংবাদিকেরা ভালো নয়। এবার তো প্রমাণ হলো। যদিও এখনও কিছুই প্রমাণিত হয়নি। মাত্র হিসাব চাওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে কারো হিসাব তলব করা মানেই, সবাই ধরে নেবেন, ডালমে কুছ কালা হ্যায়। কোনোকিছু প্রমাণের আগেই ১১ সাংবাদিক নেতাকে সামাজিকভাবে অপদস্থ করা হলো। আর শুধু ১১ নেতা নয়, এ সিদ্ধান্ত গোটা সাংবাদিক সমাজ সম্পর্কেই বাজে ধারণার স্রোতকে আরো প্রবল করবে। বাংলাদেশে ভালো বেতন পায়, এমন সাংবাদিক যেমন আছেন; আবার নামমাত্র বেতন, তাও মাসের পর মাস বকেয়া, এমন সাংবাদিকও আছেন। অল্প সময়েই টাকার পাহাড় বানিয়ে অসৎ সাংবাদিক যেমন আছেন, আবার সুযোগ সত্ত্বেও দুর্নীতির ফাঁদে পা না দিয়ে কষ্টে-সৃষ্টে জীবনযাপন করছেন, এমন সাংবাদিকও আছেন। এই সিদ্ধান্ত সবাইকেই কমবেশি হেয় করবে। তবে হেয় হতেও আমার আপত্তি নেই। যদি সরকার দুর্নীতিবাজ সাংবাদিকদের চিহ্নিত করতে কোনো চিরুনি অভিযান চালায়, আমি আরো বেশি স্বাগত জানাবো। সরকার তালিকা করে ৫০০ বা এক হাজার সাংবাদিকের হিসাব তলব করুক। সমস্যা নেই। কিন্তু এ তলবকে তেমন কোনো অভিযান মনে হচ্ছে না। বিএফআইইউ ঢালাওভাবে ছয়টি সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে। এটা সত্যি বিস্ময়কর।

দুর্নীতিবাজ সাংবাদিক নেতা হতেও পারেন, নাও হতে পারেন। দুর্নীতি করাটা নেতা হওয়ার পূর্বশর্তও নয়, সমান্তরালও নয়৷ সরকারের কাছে যদি সাংবাদিক নেতাদের কারো ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য থাকতো, যদি তেমন কারো হিসাব তলব করতো; তাহলে কোনো সমস্যা ছিলো না। কিন্তু ঢালাও নেতাদের হিসাব তলব পুরো প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাই নষ্ট করে দিয়েছে। যাদের হিসাব তলব করা হয়েছে, তাদের মধ্যে সরকার সমর্থক যেমন আছেন, সরকার বিরোধীরাও আছেন। দুইপক্ষ মিলে কোনো দুর্নীতি করেছে, সেটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। যদি এমন হতো, দেশের সকল পেশাজীবী সংগঠনের শীর্ষনেতাদের হিসাব তলব করা হচ্ছে। তাহলে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো আলোচনারই সুযোগ থাকতো না।

আবার সাংবাদিক নেতাদের হিসাব চাইতে হলে, আগে অন্য সংগঠনের নেতাদেরও হিসাব তলব করতে হবে; তেমন অন্যায় আবদারও করছি না আমি। খালি বলতে চাই, সন্দেহ করার মত সুনির্দিষ্ট তথ্য সরকার যে কারো হিসাব চাইতে পারে। কিন্তু সন্দেহ করার মত তথ্যটা কী সেটাই আমরা জানতে পারছি না।

আরেকটা ভয়ংকর বিষয় হলো, যে ইউনিট হিসাব তলব করেছে মানি লন্ডারিং, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর অস্ত্রের বিস্তার রোধকল্পে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা ব্যাংকিং হিসাব–নিকাশের অনুসন্ধান করে এবং প্রাপ্ত তথ্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে জানায়। তাহলে বিএফআইউ বা যে সংস্থা তথ্য চেয়েছে, তারা কি সন্দেহ করছেন, সাংবাদিক নেতাদের কেউ মানি লন্ডারিং বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর মত অস্ত্রের বিস্তারের সাথে জড়িত। তেমন গুরুতর কিছু হলে সেই সংস্থার উচিত প্রাথমিক তদন্ত শেষে সন্দেহভাজনদের চিহ্নিত করে শুধু তাদের হিসাব তলব করা, তিনি নেতা হোন আর না হোন। ঢালাওভাবে নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলব করে, পুরো প্রক্রিয়াটিকে বিতর্কিত করা হচ্ছে; তাতে সত্যিই কোনো অপরাধী থাকলে তিনিও পার পেয়ে যেতে পারেন।

এমনিতে বাংলাদেশে এখন সরকার সমর্থিত বা স্বেচ্ছা সমর্পিত সাংবাদিকের সংখ্যাই বেশি। করে নাকো ফোসফাস, মারে নাকো ঢুসঢাস মার্কা সব। তারপরও সরকার বিভিন্ন সময় সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করতে নানা আইন করে। ১১ নেতার ব্যাংক হিসাব তলবকেও অনেকে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের চেষ্টা হিসেবে দেখছেন। তবে তথ্যমন্ত্রী, সেতুমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ নীতিনির্ধারকদের কথায় মনে হচ্ছে, তারা কিছুই জানেন না। তাহলে বিএফআইইউ কার নির্দেশে এত বড় সিদ্ধান্ত নিলো।

আবার কারো ব্যাংক হিসাব তলব করতে মন্ত্রীদের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, তেমনও নয়। বারবার যেটা বলতে চাইছি, ব্যাংক হিসাব তলব করার আগে প্রাথিমক তদন্ত এবং সন্দেহ করার মত তথ্য থাকতে হবে। বিএফআইইউ যদি একমাস পর জানায়, কারো একাউন্টে কোনো সমস্যা নেই। তাহলেই কি মিটে যাবে বিষয়টা? সবকিছু এত সরল নয়। ১১ নেতা যদি তখন বলেন, এই একমাস যে আমাদের সামাজিকভাকে হেয় করা হলো, তার জবাব কী? অতীতে অনেক ব্যক্তি বিচারের আগেই সামাজিক পারসেপশন আর মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হয়েছেন। এবার সাংবাদিক নেতারা পরলেন সেই গাড্ডায়।

বাংলাদেশের সব সমস্যা সমাধানের ভার আমরা একজনের কাছেই ঠেলে দিই৷ সাংবাদিক নেতাদের ব্যাংক হিসাব তলবের বিষয়টি মেটানোর বলও প্রধানমন্ত্রীর কোর্টে ঠেলে দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি দেখবেন, এই আশ্বাসে আপাতত সাংবাদিকরা তাদের কর্মসূচি স্থগিত রেখেছেন। কিন্তু আমার কৌতূহল, প্রধানমন্ত্রী কী সমাধান দেবেন। যে বা যারা সিদ্ধান্তটি নিয়েছেনন, তারা খুব কৌশলে নিয়েছেন।

সাংবাদিকদের দাবি মেনে প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্তটি স্থগিত বা প্রত্যাহার করলেন; তাতেই কি সব মিটে যাবে? বিষয়টা কিন্তু অত সরল নয়। তখন সবাই বলবে, নিশ্চয়ই সাংবাদিক নেতাদের মধ্যে কোনো ঘাপলা ছিলো, নইলে হিসাব দিতে তাদের সমস্যা কোথায়?

ব্যাংক হিসাব তলবের সিদ্ধান্ত স্থগিত বা প্রত্যাহার নয়; আমি বরং দাবি করছি তলব করা ব্যাংক হিসাব প্রকাশ করা হোক। আমরা দেখতে চাই, আমাদের নেতারা কতটা সৎ? আমরা তাদের নিয়ে গর্ব করতে চাই। পাশাপাশি দাবি করছি, প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটি, বিএফইউজে, ডিইউজেসহ সাংবাদিকদের সকল প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনে নির্বাচন করতে হলে, সবাইকে তার সম্পদের হিসাব জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা হোক।

অন্য মানুষের দুর্নীতি, নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। সাংবাদিক মানেই ধান্ধাবাজ, চাঁদাবাজ এই পারসেপশন বদলে আমরা উচ্চ নৈতিকতা নিয়ে মাথা উঁচু করে নিজেদের পেশায় মনোনিবেশ করতে চাই। সাংবাদিকরা হবে উচ্চ নৈতিকতার আর সাংবাদিক নেতারা হবেন সুউচ্চ নৈতিকতার, যেন কেউ আর আমাদের দিকে আঙ্গুল তুলতে না পারে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

ছুটির দিনে মুখর সোহরাওয়ার্দী

নুসরাত জাহান ঐশী: আজ সপ্তাহিক ছুটির দিনে রাজধানীর প্রাণকেন্দ...

ভারত ছাড়লেন সালমান খান

বিনোদন ডেস্ক : বলিউডের ভাইজান খ্যাত সুপারস্টার সালমান খান। স...

বিটরুটের উপকারিতা

লাইফস্টাইল ডেস্ক : বিটরুট হচ্ছে এ...

শিব নারায়ণ দাস আর বেঁচে নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের জাতী...

ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক : সরকারিভাবে মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম...

দুই ঘণ্টা গ্যাস বন্ধ থাকবে 

জেলা প্রতিনিধি: নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে...

সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে পরবর্তী হামলা করা হবে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইরানি পররাষ্ট্...

নিহতের সংখ্যা ছাড়াল ৩৪ হাজার

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ফিলিস্তিনের অব...

তাপপ্রবাহ থাকবে আরও ৩ দিন 

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীসহ

টিভিতে আজকের খেলা

স্পোর্টস ডেস্ক: প্রতিদিনের মতো আজ...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা