সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
মতামত

বিপদে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা:

মাথা তুলছে বেকারত্ব, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ। করোনার বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ায় অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের গতি বাড়ছে। শহর, উপ-শহর ও গ্রাম- সারা দেশেই কাজের গতি এসেছে। কিন্তু মানুষের জন্য কাজ তৈরির পথ এখনও মসৃণই হয়নি। কর্মসংস্থানের ছবিতে অর্থনীতির গতির প্রতিফলন কম। খেটে খাওয়া মানুষ যদিওবা কিছু একটা করে টিকে থাকছে, বেশি বিপদে পড়েছে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস)- এর এক জরিপে উঠে এসেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার থাকছেন। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান। ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী এখনও অন্য কোনও বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছেন কিংবা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ৩ শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু করছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে এখন মোট শিক্ষার্থী আছেন ২০ লাখের মতো।

ছবিটা উদ্বেগজনক। যোগ্য চাকরি জোগাড় করা দুরূহ কাজ। কিন্তু উপরোক্ত চিত্র জানিয়ে দেয় যে উপযুক্ততা অনেক দূরের ব্যাপার, একটা কাজই জোগাড় হচ্ছে না বেশিরভাগ তরুণ-তরুণীর। সমস্যাটি কেবল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নয়। অন্যান্য পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন, তাদের চাকরির বাজারও ভালো নয়।

বিআইডিএস প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান। তার গবেষণার মূল্য এবং গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। সেই সংস্থা যখন এমন তথ্য দেয়, তখন তাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হয়। বাংলাদেশে বেকারত্বের হার সাধারণত শিক্ষিতদের মধ্যেই বেশি হয়ে থাকে। এখানেই শিক্ষা আর কাজের সম্পর্ক নিয়ে আমাদের ভাবতে হয়। অর্থনীতির আলোচনায় কর্মসংস্থানের সমস্যা নিয়ে যে আলোচনা হয়, সেখানে নীতি-নির্ধারকদের দিক থেকে যতটা প্রতিশ্রুতি থাকে, ততটা থাকে না সমাধানের ইঙ্গিত। সম্পদ আর কর্মসংস্থান সৃষ্টিই অর্থনৈতিক পরিকল্পনার আসল উদ্দেশ্য।

বাংলাদেশ এখন উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশ। মানুষের মাথাপিছু আয়ও বেশি। সেই বাস্তবতায় কর্মসংস্থানে সাফল্যই প্রত্যাশিত। বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি পেতে তরুণ সমাজের মধ্যে আকাঙ্ক্ষাই বলে দেয় কর্ম সৃজনের জন্য যে শক্ত ব্যক্তি খাত প্রয়োজন, সেটা আমরা গড়ে তুলতে পারিনি কিংবা যেটুকু গড়ে উঠেছিল সেটা নষ্ট করেছি।

বেকারত্ব কমানোর সরকারি প্রচেষ্টা থাকবে, সেটাও ঠিক। কিন্তু বিআইডিএসের গবেষণা-ফল বলে দিচ্ছে, বাংলাদেশে এখন শিক্ষার সঙ্গে চাকরি বা কর্মসংস্থানের সম্পর্কগত ধারণা বদলে যাচ্ছে। শিক্ষিত হলেই কাজ মিলবে, এমন ধারণা আর থাকছে না। অ্যাকাডেমিক জীবনে ভালো ফল করলেই ক্যারিয়ার-গ্রাফ ভালো হবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। যে যে বিষয়ে পড়ছে, সে বিষয়ে কাজ পাচ্ছে না বা সেই ক্যারিয়ার তার কাছে আকর্ষণীয় লাগছে না। তাই প্রকৌশলী বা চিকিৎসক বিসিএস দিয়ে যাচ্ছেন পররাষ্ট্র দফতরে, প্রশাসনিক বা পুলিশ ক্যাডারে।

প্রাণিবিজ্ঞানে পড়ালেখা করে কাজ করছেন ব্যাংকে বা বিমা খাতে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে কর্মের কোনও সাযুজ্য নেই। অথচ শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যই এই সাযুজ্য, উপযুক্ত সম্মান এবং যোগ্যতা অনুসারে অর্থ উপার্জন নিশ্চিত করা। কর্মসংস্থানের জন্য দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যশাস্ত্রের জয়জয়কার। প্রচুর ছেলেমেয়ে বিবিএ আর এমবিএ করে বের হচ্ছে প্রতিবছর। তাদের প্রায় সবাই চায় চাকরি। আত্মকর্মসংস্থান, অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্য করতে যে ধরনের ব্যক্তিগত অবকাঠামো প্রয়োজন, সেখানেও সমস্যা আছে।

বিআইডিএস বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে যারা বেকার থাকছেন, তাদের অধিকাংশই ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের বাইরে অন্যান্য বিষয়ে পড়াশোনা করা। অর্থাৎ ব্যবসায় প্রশাসনে পড়া শিক্ষার্থীরাই তুলনামূলক বেশি চাকরি পাচ্ছেন। নিজস্ব উদ্যোগে কাজ করার ক্ষেত্রেও ব্যবসায় প্রশাসনের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে রয়েছেন। শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, শিক্ষিতদের বড় একটা অংশ যদি উন্নয়ন প্রক্রিয়ার বাইরে থাকে, তাহলে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। এত রাষ্ট্রীয় ও পারিবারিক বিনিয়োগের পর একটি ছেলে বা মেয়ে বেকার থাকলে তা শুধু কষ্টদায়ক নয়, বরং বলতে হবে সম্পদের অপচয়।

এত এত উচ্চশিক্ষিত প্রতিবছর সৃষ্টি করে উপকার কী হচ্ছে, সে প্রশ্ন নিশ্চয়ই উঠতে পারে। এত শিক্ষিত জনগোষ্ঠী থাকার পরও আমাদের করপোরেট-জগতে বিপুল বিদেশিকে ডেকে আনতে হচ্ছে উচ্চ বেতনে। এ বিষয়টা ভাবা দরকার। কেন এমন হচ্ছে সেই কারণ খুঁজে বের করা দরকার।

আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখছি, গরিবেরা বেকার থাকে না। দরিদ্রদের মধ্যে বেকার কম। বেকার সমস্যা বলে সচরাচর যাকে আমরা চিনি, তা আসলে যারা শিক্ষিত এবং তারাই আসলে কাজ পান না। আর বড়লোকদের বেকার হওয়ার সুযোগই নেই। ভাবনা মধ্যবিত্তকে নিয়ে, যাদের কাজের সুযোগ প্রসারিত হচ্ছে না। কারিগরি বিদ্যায় দক্ষ একজন বড় বেতনের কাজ পায়, তার কাজের অভাবও হয় না; কিন্তু তার কোনও সামাজিক মর্যাদা সৃষ্টি হয় না। আর এভাবেই শিক্ষিত বেকার তৈরি হয়। শিক্ষিত বিশাল এক জনগোষ্ঠীর অকারণ অযোগ্য উচ্চাশা উচ্চারিত আকাশে-বাতাসে।

এত মানুষ, অথচ উদ্যোক্তারা বলেন, তারা চাকরিপ্রার্থী লাখ লাখ পেলেও সত্যিকারের কাজের লোক পান না। ভালোভাবে বুঝতে হবে কেন বিভিন্ন ধরনের কাজে শ্রমের বাজারে চাহিদা আর জোগানে মিল থাকছে না। পরিকল্পনায় যারা আছেন, তারা শিক্ষা নিয়ে ভাবুন, ভেবে ঠিক করুন দেশে শিক্ষিত বেকারের জোগান বাড়বে, নাকি এমন শিক্ষা ব্যবস্থা হবে, যেখান থেকে সত্যিকারের কর্মী বাহিনী সৃষ্টি হবে।

লেখক: সাংবাদিক

সান নিউজ/এফএইচপি

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

সম্মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নির্বাচন সম্পন্ন

কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী (ফরিদপুর) : ফরিদপুর জেলার সদর ইউনিয়...

ভোলায় অনুষ্ঠিত হলো প্রাণী প্রদর্শনী মেলা

ভোলা প্রতিনিধি: ‘প্রাণিসম্পদে ভরবো দেশ, গড়বো স্মার্ট ব...

সম্মিলনী বিদ্যালয়ের সভাপতি ফিরোজ আহমেদ

কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী (ফরিদপুর) : ফরিদপুর জেলার সদর ইউনিয়...

বাংলাদেশ স্কাউট দিবস ২০২৪ পালিত

নিজস্ব প্রতিবেদক : আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে অনুষ্...

ভাসানচরে এক রোহিঙ্গাকে গলা কেটে হত্যা

নোয়াখালী প্রতিনিধি : নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যা...

ভাসানচরে এক রোহিঙ্গাকে গলা কেটে হত্যা

নোয়াখালী প্রতিনিধি : নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যা...

আলিয়ঁসে সুরঞ্জনার ‘সিবীত কোলাজ’ প্রদর্শনী

সাজু আহমেদ: রাজধানী ঢাকায় চিত্র প...

গরমে ত্বক সতেজ রাখুন

লাইফস্টাইল ডেস্ক : গরমে মধ্যে ত্বক হয়ে পড়ে নিষ্প্রাণ। তাই এই...

চিয়া সিডের পুষ্টি গুন

লাইফস্টাইল ডেস্ক : চিয়া বীজ হল সালভিয়া হিসপানিকা ভোজ্য বীজ...

সোনার দামে নতুন রেকর্ড

নিজস্ব প্রতিবেদক: সোনার দাম আবারও বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে বাং...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা