মতামত

অধ্যক্ষের ফোনালাপ ফাঁস নিয়ে জরুরি আলাপ

মেহেদি রাসেল : বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিব কোথা’। একটা জাতির যখন সমস্ত জায়গায় ‘ব্যথা’ হয় তখন ওষুধ প্রয়োগ করাটা বেশ ঝুঁকিও ঝঞ্ঝাটপূর্ণ ব্যাপারই বটে। আমরা নানা সময়ে দেশের গণ্যমান্য লোকেদের মুখে ‘ঝাঁকি’ তত্ত্ব শুনেছি, কিন্তু ‘ঝুঁকি’ বিষয়ে তাদের মূল্যবান মূল্যায়ন আমাদের শোনার সৌভাগ্য হয়নি। তবে, ঝাঁকি দিয়ে দালান ধসিয়ে দেওয়ার মতো না হোক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিন্তু সমাজে বেশ জোরেশোরে ঝাঁকি দিতে পেরেছে। ঝাঁকি যে দিতে পেরেছে, তার প্রমাণ হলো, হরহামেশা এক একটা নিত্যনতুন বিষয় এখানে ভাইরাল হয় এবং আমরা সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্যাপারটা নিয়ে নানা ‘বিশেষজ্ঞ’ মতামত দিতে থাকি। বলা বাহুল্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই ঝাঁপিয়ে পড়া অতি উৎসাহী তর্ক অধিকাংশ ক্ষেত্রে অমীমাংসিতভাবে শেষ হয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ঢুকে একটা বিষয় টের পেলাম-ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষের ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। ব্যক্তিগত ফোনালাপ শোনার মতো উৎসাহ না থাকলেও যথারীতি নিউজফিড স্ক্রল করতে গিয়ে দেখলাম জনতা বেশ ‘মওকা পেয়েছি’ ভঙ্গিতে সেই শিক্ষকের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে ব্যস্ত। ভদ্রমহিলা সম্ভবত ব্যক্তিগত আলাপে ‘শিক্ষকসুলভ’ ভাষারীতি মেনে চলেননি। ফেসবুকবাসী, আদর করে যাদের অনেকেই নেটাগরিক ডাকে, তারা শিক্ষিকার এহেন ভাষা ব্যবহারে ক্ষুব্ধ এবং তাদের ক্ষোভের প্রকাশও খুব ভদ্র নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আগেকার দিনে শিক্ষকেরা কেমন মহৎ ছিলেন আর আজ সবকিছু উচ্ছন্নে গেছে ধরনের হাহাকার।

ব্যক্তিগত জীবনের একান্ত আলাপে একজন মানুষ সারাক্ষণ তার পেশাগত দিক বিবেচনা করে আচরণ করবেন-আমি সেই আবদারের বিপক্ষে। তবু, আমার পক্ষপাতে কী বা যায় আসে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে চিন্তিত নেটাগরিকগণ সুচিন্তিতভাবেই নিশ্চয়ই কোনো না কোনো পক্ষ নেন।

হয়তো ভাবমূর্তির কারণেই শিক্ষকের কাছে তাদের চাওয়াটা একটু বেশি, সেই জায়গা থেকে আশাহত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটলে জনগণের প্রতিক্রিয়া একটু বেশি হবে বৈকি। সেটাও তেমন দোষের কিছু নয়। কিন্তু আমার প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। এই যে ব্যক্তিগত ফোনালাপ ফাঁস এটাই তো একটা বড় ধরনের অপরাধ। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকারের পর্যায়ে পড়ে। এবং এটি লঙ্ঘিত হলে শাস্তির ব্যবস্থা আছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটি হলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এ রকম কোনো ফোনালাপ প্রকাশিত হয়ে পড়লে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে আলাপের বিষয় নিয়ে বিস্তর হাস্যরসের সৃষ্টি হয়, কিন্তু খোদ ফাঁস করার ঘটনাটাই যে বেআইনি, সে বিষয়ে আমরা অনেকেই চুপ করে থাকি। হাস্যরসের খোরাক পেয়ে আমরা অপরাধটা বেমালুম ভুলে যাই। অর্থাৎ ‘অনৈতিক’ বিষয় নিয়ে আমাদের যতটা মাথা ব্যথা, ‘অপরাধ’ নিয়ে ততটা নয়। যদিও এর উল্টোটা হওয়াই স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক ছিল। এই সুযোগে বড় বড় সংস্থাগুলো যখন নাগরিকদের একান্ত গোপনীয় বিষয় ফাঁস করে দেয়, সেটা আর প্রশ্নের মুখে পড়ে না। কেননা, তত দিনে আমাদের চর্চার ভেতর থেকে বিষয়টি বাদ পড়ে গেছে। যদিও প্রতিষ্ঠানের অপরাধ আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে সংগঠিত অপরাধের মাত্রা ও অভিঘাতের পার্থক্য বিস্তর, কিন্তু গণমানুষের এই চর্চা কিছুটা হলেও সেই সুযোগ তৈরি করে দেয়।

বিষয়টা অনেকটা ক্রসফায়ারের শুরুর দিকের ঘটনার মতো। অভিযুক্ত ‘কুখ্যাত’ কাউকে ক্রসফায়ার করলে একসময় জনমনে বেশ খুশির আমেজ বইত। প্রথম প্রথম তারা এর আইনগত দিকটিকে একেবারে উপেক্ষা করে এই হত্যাকে সমর্থন করত। যার ফলে একসময় গোটা রাষ্ট্রকেই এর খেসারত দিতে হয়। প্রথমে অভিযুক্ত, এরপর ক্রসফায়ারের নামে আমরা বিভিন্ন সময়ে অনেক নিরপরাধ মানুষকে খুন হতে দেখেছি। সেটা অনেকটাই সম্ভব হয়েছে ক্রসফায়ারের পক্ষের জনমতের কারণে। কিন্তু, একটা অন্যায় ঠেকাতে আরেকটা অন্যায় করা কোনো কোনো সমস্যারই সমাধান দেয় না। ক্রসফায়ারে অপরাধ কমেছে বলে কোনো শুমারি এখনো আমাদের চোখে পড়েনি।

সে কারণে ফোনালাপ ফাঁসের মতো ঘটনা যখন আমাদের সামনে আসে, আমাদের উচিত সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা। যারা ফোনে আলাপ করেছেন তাদের দিকে আঙুল না তুলে যারা আলাপটা ফাঁস করল তাদের দিকে আঙুল তোলা উচিত। কিন্তু, সর্বাঙ্গে যে ব্যথা তার ওষুধ কোথায় পাওয়া যায়? ধর্ষণের ঘটনায় আমরা ভিকটিমের দিকে আঙুল তুলি, ক্রসফায়ারে আমরা নিহত ব্যক্তির অপরাধের দিকে আঙুল তুলি, ফোনালাপ ফাঁসে আমরা আলাপকারীর দিকে আঙুল তুলি বলেই এসব অপরাধ অনায়াসে ঘটতে থাকে। সমস্যার গোড়া নিয়ে কথা না বলে আশপাশ দিয়ে কথা বললে কিছুটা সুড়সুড়ি ধরনের সাময়িক আনন্দ পাওয়া যায় বটে, কিন্তু তাতে সর্বাঙ্গের ব্যথা বাড়ে বই কমে না।

লেখক : মেহেদি রাসেল কবি ও সংবাদকর্মী

সান নিউজ/এনএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

কোচিং সেন্টারে মিলল বিপুল অস্ত্র-বিস্ফোরক

রাজশাহী নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকায় একটি বাড়ি থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক তৈরি সরঞ্জাম...

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র...

আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক শেষ, যুদ্ধ স্থগিতের ঘোষণা নেই

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট...

‘গোপন রাজনীতি’, ছাত্রশিবির ও ডাকসু নির্বাচন নিয়ে উত্তপ্ত ঢাবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্টরুম সংস্কৃতি এবং এই কেন্দ্রিক নির্যাতন গত ১৫ বছরে ছি...

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মালয়েশিয়ার প্রভাব কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ

দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা...

ফের ৯৮ বাংলাদেশিকে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠাল মালয়েশিয়া

ফের কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়েছে ৯৮ বাংলাদেশিকে। বিম...

‘গোপন রাজনীতি’, ছাত্রশিবির ও ডাকসু নির্বাচন নিয়ে উত্তপ্ত ঢাবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্টরুম সংস্কৃতি এবং এই কেন্দ্রিক নির্যাতন গত ১৫ বছরে ছি...

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মালয়েশিয়ার প্রভাব কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ

দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা...

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

কোনো চাঁদাবাজকে বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র...

আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক শেষ, যুদ্ধ স্থগিতের ঘোষণা নেই

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা