মতামত

পর্যাপ্ত উৎপাদন : তবুও কমে না চালের দাম

আব্দুল হাই রঞ্জু

বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতিনিয়তই দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে। অথচ ভৌগোলিক সীমারেখা কার্যত স্থির। উল্টো বসতবাড়ি, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং নগরায়ণের কারণে প্রতিবছরই চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমে আসছে। তবে সরকারিভাবে কৃষি উপকরণের সরবরাহ, প্রণোদনা, সার, বীজে সহায়তা অব্যাহত আছে।

ফলে ঝড়, বৃষ্টি, আম্ফান, ইয়াসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে দেশের কৃষকের নিরন্তর প্রচেষ্টায় খাদ্য উৎপাদন বেড়েই চলছে। মূলত দেশের কৃষি বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরলস প্রচেষ্টায় কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, যান্ত্রীকীকরণ, উচ্চফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন কৃষিতে অভাবনীয় সফলতা এনেছে।

এমনকি বিশ্বে চাল উৎপাদনকারী শীর্ষে থাকা ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশকে টপকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) থেকে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল ফুড আউটলুক-জুন ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবারও ইন্দোনেশিয়াকে টপকে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় চাল উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে জায়গা করে নিতে যাচ্ছে।

যদিও ইন্দোনেশিয়া টানা ৩ বছর চাল উৎপাদনে বাংলাদেশের নিচে অবস্থান করলেও তারাও তাদের আগের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সময়েই বলে দেবে বাংলাদেশ সামনের বছরগুলোতে চাল উৎপাদনের সফলতা কতটুকু ধরে রাখতে পারবে।

আর বাস্তবতা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশকে মোকাবিলা করে চাষাবাদ করতে হয়। আবার মাঝে মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি টানা খরার কবলে পড়ে বাংলাদেশের কৃষিকে প্রতিকূল পরিস্থিতিও সামাল দিতে হয়। বিশেষ করে সম্প্রতি সমুদ্রের তাপমাত্রা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সমুদ্রের তলদেশের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সাগরের লোনা পানি উপকূলীয় অঞ্চলে ঢুকে পড়ায় কৃষি চাষাবাদের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

যদিও লবণাক্ততার আগ্রাসন থেকে বাংলাদেশের কৃষিকে বাঁচাতে কৃষি বিজ্ঞানীরা লবণসহিষ্ণু জাতের ধান উদ্ভাবনে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আমরা আশাবাদী, আমাদের দেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা লবণসহিষ্ণু জাতের দানাদার খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবে এবং বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে যে অভাবনীয় সফলতা অর্জন করেছে তা উত্তরোত্তর আরও বৃদ্ধি পাবে।

বাস্তবতা হচ্ছে, এসব কারণে উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান, গম ও সবজি উৎপাদনে গবেষণা বৃদ্ধি করতে হবে। এ জন্য কৃষি গবেষণা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও বাড়াতে হবে। কারণ ছোট্ট ভূখণ্ডের বাংলাদেশে জনসংখ্যার চাপ অনেক বেশি।

ফলে বৃহৎ এই জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার যে চ্যালেঞ্জ তা মোকাবিলায় কৃষি গবেষণা খাতকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে খাদ্য আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না। এ বছরও বিপুল পরিমাণ দানাদার খাদ্য আমদানি হয়েছে। এরমধ্যে ১৮ লাখ টন চাল ও ৬৪ লাখ টন গম আমদানি করতে হয়েছে। যদিও গত বছর গম আমদানির পরিমাণ ছিল ৬০ লাখ টন। অর্থাৎ প্রতিনিয়তই আটা ময়দার চাহিদা বাড়ছে।

ফলে প্রতিবছরই গম আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু সে হারে উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে না। অথচ গম আবাদের যথেষ্ট সুযোগ দেশে থাকার পরও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও উপযুক্ত পদক্ষেপের অভাবে দেশে গমের আবাদ দিন দিন কমে যাচ্ছে। অথচ দেশে প্রচুর পরিমাণ গম আবাদের সুযোগ ও সম্ভাবনা বিদ্যমান আছে। মূলত দোআঁশ মাটিতে স্বল্প সেচে গমের ভালো ফলন হয়। আর আমাদের নদীমাতৃক দেশে এখন বিশাল বিশাল চরের সৃষ্টি হচ্ছে।

এসব চরাঞ্চলে স্বল্প সেচে গমের ব্যাপক চাষাবাদ হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও সরকারি সুযোগ-সুবিধার অভাবে চাষিরা এসব জমিতে আলু, ভুট্টা, কলার বাগানসহ নানা জাতের সবজি চাষাবাদ করছে। অথচ চরাঞ্চলে উচ্চ ফলনশীল জাতের গমের বীজ, সার ও নগদ অর্থ সহায়তা দিলে চাষিরা গম চাষের দিকেই ঝুঁকতেন।

যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকার পরও কেন সরকার গম আবাদের বদলে গম আমদানির দিকেই বেশি আগ্রহ দেখায়, বোধগম্য নয়। তবে গমে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ ও অন্যান্য রোগে আক্রান্তের ভয়ে চাষিরা গম চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এ জন্য গবেষণা করতে হবে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন বীজ উদ্ভাবন করে কৃষক পর্যায়ে বিনামূল্যে সরবরাহ করতে হবে।

উত্তরাঞ্চলের মধ্যে ঠাকুরগাঁও এবং দিনাজপুরে এখনো প্রচুর পরিমাণ গমের আবাদ হচ্ছে। এই দুই জেলার বাইরেও উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য জেলায় গমের আবাদের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গম চাষাবাদের দিকে বেশি করে নজর দিতে হবে।

যেখানে দানাদার নিত্যপণ্য হিসেবে গমের চাহিদা বাড়ছে, সেখানে আমরা শুধু বৈদেশিকে মুদ্রা খরচ করে প্রতিবছরই বেশি পরিমাণ গম আমদানি করছি। এ প্রবণতা কোনোভাবেই কৃষি অর্থনীতির জন্য শুভ হতে পারে না। যদি ধান ও অন্যান্য সবজি উৎপাদনে আমরা অভাবনীয় সফলতা অর্জন করতে পারি, তাহলে গম উৎপাদনে কেন পিছিয়ে যাচ্ছি? অবশ্যই এ জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার উপযুক্ত পদক্ষেপের অভাবই দায়ী।

তবে স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, গত কয়েক বছর ধরে ধান চাষিরা ধানের উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছেন। ফলে ধানের আবাদ যথেষ্ট পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও ধান বেশি পরিমাণ আবাদ হওয়ায় চালের দাম কমে আসার কথা। কিন্তু এটাও সত্য, ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও চালের দাম ভরা মৌসুমেও কমছে না।

মূলত বৈশ্বিক মহামারী করোনার বিরূপ প্রভাবে গোটা দুনিয়ায় খাদ্য সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে কম বেশি প্রতিটি দেশেই চালের দাম তুলনামূলক এখনো বেশি। যার প্রভাবে বাংলাদেশেও চালের দাম কমছে না। আবার সরকার আপদকালীন খাদ্য মজুদ গড়ে তুলতে এ বছর বিপুল পরিমাণ ধান ও চাল সংগ্রহ অব্যাহত রেখেছে। ফলে চালের বাজার এখন ঊর্ধ্বমুখী। অবশ্য এতে সাধারণ ভোক্তার কষ্ট বেড়েছে।

এরপরও যদি সরকার অভ্যন্তরীণভাবে ধান চাল সংগ্রহ করে কাক্সিক্ষত পরিমাণ চালের মজুদ গড়ে তুলতে পারে, তাহলে যে কোনো পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। যদিও সরকার ধান, চাল উৎপাদনের তুলনায় যৎসামান্যই অভ্যন্তরীণভাবে সংগ্রহ করে থাকে, তবুও সরকারের আপদকালীন খাদ্য মজুদ সাধারণ ভোক্তার স্বার্থে বড় মাপের অবদান রাখে। কারণ চালের দাম বেড়ে গেলে সরকার খোলাবাজারে স্বল্পমূল্যে চাল বিক্রি করাসহ বিভিন্ন চ্যানেলে খাদ্য সরবরাহ বৃদ্ধি করে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।

আশার খবর হচ্ছে, দেশে এ বছর বোরোর আবাদ ভালো হয়েছে। আউশ ও আমনেও ভালো আবাদের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে হবে। কারণ শুধু বোরো মৌসুমে ভালো উৎপাদন দিয়ে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।

তবে এখন দক্ষিণাঞ্চলসহ গোটা দেশেই আউশ ও আমন ধানের ব্যাপক চাষাবাদ হচ্ছে। আমরা আশাবাদী, বোরোর পাশাপাশি আউশ ও আমনেও ধানের আবাদ ভালো হবে। আর গোটা দেশে ধানের চাষাবাদ যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অনেকাংশেই সম্ভব হবে।

আব্দুল হাই রঞ্জু : সাবেক ছাত্রনেতা

সান নিউজ/এমএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

মফস্বল সাংবাদিক ফোরামের ১১০ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন

মফস্বল ও প্রান্তিক পর্যায়ে কর্মরত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, হামলা, হ...

মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে স্বতন্ত্রসহ চারজনের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ

মুন্সীগঞ্জে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীসহ চারজন প্রা...

নাসার চাঁদে অভিযানের দায়িত্বে স্পেসএক্স না ব্লু অরিজিন?

পরবর্তী চাঁদ অভিযান কর্মসূচিতে কোন প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা হবে নাসার নতুন প্রশ...

বাজারে কৃত্রিম সার সংকট সৃষ্টির অপরাধে ব্যবসায়ীকে জরিমানা

বাজারে কৃত্রিম সার সংকট সৃষ্টির অপরাধে কুষ্টিয়ার মিরপুরে এক ব্যবসায়ীকে জরিমান...

নোয়াখালীতে বিএনপির কার্যালয়ে আ. লীগের হামলা, আহত ৪

নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়াতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপির কার্যাল...

আলফাডাঙ্গা কলেজে পরীক্ষা চলাকালে অস্ত্র হাতে মহড়া, গ্রেপ্তার যুবক

ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা আদর্শ কলেজে স্নাতক সম্মান (ডিগ্রি) পরীক্ষা চলাকালে দেশীয়...

মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে স্বতন্ত্রসহ চারজনের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ

মুন্সীগঞ্জে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীসহ চারজন প্রা...

চাকসুর উদ্যোগে ইসলামী ব্যাংক–চবি’র কর্পোরেট চুক্তি

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি কর্পোরেট...

সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর ঝালকাঠিতে সড়ক অবরোধ প্রত্যাহার

ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার সন্তান সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগঠন ‘ইনকিলাব ম...

বাজারে কৃত্রিম সার সংকট সৃষ্টির অপরাধে ব্যবসায়ীকে জরিমানা

বাজারে কৃত্রিম সার সংকট সৃষ্টির অপরাধে কুষ্টিয়ার মিরপুরে এক ব্যবসায়ীকে জরিমান...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা