মতামত

আমরা মরছি, তোমরা বেড়াচ্ছ মহাকাশে?

ফারুক ওয়াসিফ : নিরোরা এখন মহাকাশে গিয়েও বাঁশি বাজাচ্ছেন। এ যাবৎ পৃথিবীতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় বিশ কোটি মানুষ। মৃত্যুবরণ করেছেন সাড়ে একচল্লিশ লাখ। কিন্তু বিশ্বের গণমাধ্যম মাতোয়ারা হয়ে ছিল তিন ধনকুবেরের মহাকাশ ভ্রমণের রোমাঞ্চকর খবরে। তাঁরা সেখানে কী দেখলেন, কী খেলেন, কোথায় টয়লেট করলেন ইত্যাদি। তিনজনই মারাত্মক রকম ধনী। মহাকাশে বেড়াতে যাওয়া ব্রিটিশ ধনকুবের রিচার্ড ব্র্যানসন, আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বোজোস, এবং প্রযুক্তি-মোগল ইলন মাস্ক দুনিয়ার সবার থেকে আলাদা হয়ে গেলেন। নিজস্ব নভোযান হয়েছে তাঁদের। তাঁরা যখন তারার রাজ্যে বিনোদ-বিহার করছেন, তখন বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ টিকা পাচ্ছে না।

টাকার জোরে তাঁরা যখন নভোচারী বনে গেলেন, তখন খোদ আমেরিকার ২৯ শতাংশ আমেরিকান তারা দেখে ভাগ্য গণনায় বিশ্বাসী। আমেরিকার স্বনামধন্য জরিপ সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টার বলেছে এই কথা। তাঁদের দেখাদেখি আরও অনেক ধনী ব্যক্তি মহাকাশে ভ্রমণের খায়েশ জানিয়ে আগাম বুকিং দিয়েছেন। রিচার্ড ব্রানসনের ভার্জিন গ্যালাকটিক কোম্পানির নভোযানে ভ্রমণের টিকিটের জন্য আবেদন করেছেন ৮ হাজার ধনী ব্যক্তি। এই সপ্তাহেই ভ্রমণের জন্য আবেদন করেছেন ৭ হাজার ছয় শ জন।

প্রত্যেকটি টিকিটের দাম হবে আড়াই লক্ষ ডলার। এঁরা শুধু ধনী নন, এঁরা হলেন ভয়াবহ ধনী। ব্যাংক অব আমেরিকা হিসেব কষে দেখিয়েছে ২০৪০ সাল নাগাদ মহাকাশ ভ্রমণের ব্যবসা ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলার ছাপিয়ে যাবে।

ধনীরা গ্রহ-তারা ছাপিয়ে মাথা তুলছেন তখন করোনা মহামারিতে চিকিৎসা না পেয়ে কিংবা খেতে না পেয়ে মারা যাচ্ছে লাখো মানুষ। অথচ রমরমা চলছে টিকার বাণিজ্য। মানুষ অক্সিজেনের অভাবে গণহারে মরে গেলেও ক্ষতি নাই, ধনীদের অশ্লীল মহাকাশ বিলাস চলবেই।

ষাট বছর আগে মানুষ মহাকাশে গেলেও তিন ধনকুবেরের মহাকাশযাত্রাকে বলা হচ্ছে বিজ্ঞানের নতুন যুগের সূচনা। সেই নতুন যুগ এমনই প্রাচীন বৈষম্যে ভরা যে, তার সুফল কেবল কিছু লোক পাবে, তারা টিকা পাবে, তারা মহামারিতে নিরাপদে নির্জনাবাস করবে, কিন্তু সাধারণ মানুষের ভরসা কেবল ভাগ্যের সুদৃষ্টির আশা।

এদিকে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে ভারত অবধি ভয়াবহ বন্যা, ভূমিধস, দাবানল আর ভূমিকম্প জানাচ্ছে চরম প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসন্ন। টাইমস পত্রিকা শিরোনাম করেছেন, কোথাও নিরাপত্তা নাই। কিন্তু এটা পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদে যার টাকা আছে সে সব পাবে। সেই টাকা বানাতে জাতির মেধা, জনগণের মেহনত, সরকারি সাহায্য ব্যবহার করা হলেও সুফল পাবে কেবল মালিক। এটাই চরম মৌলবাদ, যারা বিশ্বাস করে পৃথিবী ধ্বংস হলে হোক, আমরা মহাকাশযানে করে অন্য গ্রহে পাড়ি জমাব। দরকারে তারা মানব জাতির আবাসস্থল এই নীল গ্রহটিকে খরচ করে ফেলবে, পৃথিবীর ঠিকানা বদলে অন্য গ্রহের ঠিকানায় চলে যাবে, কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বদলে অন্য কোনো ব্যবস্থা তারা সহ্য করবে না।

মহাকাশ খুলে দিয়েছে ব্যবসার নতুন দিগন্ত। মহাকাশ গবেষণায় সে জন্যই এত বিনিয়োগ, কিন্তু মহামারি রোধের কাজেই কেবল টাকা নাই। টাকা নাই সরকারের, টাকা নাই জাতিসংঘের, টাকা নাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। আর দেখা যাচ্ছে, জনগণের করের থেকে পাওয়া কোটি কোটি টাকা খরচ করে নজরদারি প্রযুক্তি কেনা হচ্ছে, কিন্তু সময়মতো আইসিইউ বেড বা অক্সিজেন সিলিন্ডার মিলছে না হতভাগ্য সাধারণের।

করোনা মহামারির শুরুর দিকে অনেক মনীষী অনেক আশাবাদী মানুষ ভেবেছিলেন, মানবজাতির সকলের সাধারণ শত্রু কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষ এক হবে। হিংসা ও স্বার্থচিন্তার বদলে সকলে মিলে সকলকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করবে। কিন্তু আমরা দেখলাম ধনীরা আরও ধনী হলো, গরিব হলো আরও গরিব। আমরা দেখলাম কোনো কোনো সরকার লকডাউন দিয়ে বিরোধীদের ধরপাকড় করছে। কোনো কোনো মন্ত্রণালয় হয়ে উঠল টাকা বানানোর খনি। মহামারি, জলবায়ু দুর্যোগ, বেকারত্ব ও রোগে ভুগে দুনিয়া বদলে গেল, কিন্তু ধনী ও ক্ষমতাবানেদের খাসলত বদলাল না।

বিজ্ঞান যখন পুঁজির দখলে, পৃথিবীর জলবায়ু যখন দ্রুতই নষ্ট হচ্ছে, চিকিৎসা ব্যবস্থা যখন ভারসাম্য হারাচ্ছে, তখন এসব দেখে দেখে অসহায় মানুষ আরও ভয় পাবে, আরও নিয়তিবাদী হয়ে পড়বে। চর্চা করবে অবৈজ্ঞানিক নানান পদ্ধতির। ইতিহাসের অন্ধকার যুগ কখনো বিউগল বা সানাই বাজিয়ে আসে না। তা আসে নিঃশব্দে, যেভাবে চোরাবালিতে পা দেওয়া মানুষ টের পায় না তার সমূহ মৃত্যু, সেভাবেও ধনী-গরিব সকলেই ঘুমের মধ্যে ঘোরগ্রস্তের মতো হাঁটছে।

তাহলে আশা কোথায়? আশা এখানেই যে, ইতিহাস দেখায়, মানুষ এমন কোনো সমস্যায় পড়েনি যা সে সমাধান করতে পারে না। মানুষ দেখছে এবং শিখছেও। সেটাই হয়তো একমাত্র আশা।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।
faruk. wasif@prothomalo. com

সান নিউজ/এনএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

মফস্বল সাংবাদিক ফোরামের ১১০ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন

মফস্বল ও প্রান্তিক পর্যায়ে কর্মরত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, হামলা, হ...

মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে স্বতন্ত্রসহ চারজনের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ

মুন্সীগঞ্জে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীসহ চারজন প্রা...

নাসার চাঁদে অভিযানের দায়িত্বে স্পেসএক্স না ব্লু অরিজিন?

পরবর্তী চাঁদ অভিযান কর্মসূচিতে কোন প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা হবে নাসার নতুন প্রশ...

নোয়াখালীতে বিএনপির কার্যালয়ে আ. লীগের হামলা, আহত ৪

নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়াতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপির কার্যাল...

বাজারে কৃত্রিম সার সংকট সৃষ্টির অপরাধে ব্যবসায়ীকে জরিমানা

বাজারে কৃত্রিম সার সংকট সৃষ্টির অপরাধে কুষ্টিয়ার মিরপুরে এক ব্যবসায়ীকে জরিমান...

আলফাডাঙ্গা কলেজে পরীক্ষা চলাকালে অস্ত্র হাতে মহড়া, গ্রেপ্তার যুবক

ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা আদর্শ কলেজে স্নাতক সম্মান (ডিগ্রি) পরীক্ষা চলাকালে দেশীয়...

মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে স্বতন্ত্রসহ চারজনের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ

মুন্সীগঞ্জে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীসহ চারজন প্রা...

চাকসুর উদ্যোগে ইসলামী ব্যাংক–চবি’র কর্পোরেট চুক্তি

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি কর্পোরেট...

সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর ঝালকাঠিতে সড়ক অবরোধ প্রত্যাহার

ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার সন্তান সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগঠন ‘ইনকিলাব ম...

বাজারে কৃত্রিম সার সংকট সৃষ্টির অপরাধে ব্যবসায়ীকে জরিমানা

বাজারে কৃত্রিম সার সংকট সৃষ্টির অপরাধে কুষ্টিয়ার মিরপুরে এক ব্যবসায়ীকে জরিমান...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা