ইমতিয়াজ মাহমুদ: স্বাধীনতা চাই সব কথা বলার জন্যে, সব মত ও সব চিন্তা প্রকাশের জন্যে। সম্প্রতি যে আন্দোলন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা করছেন সেন্সরের নামে কণ্ঠ রুদ্ধ করার প্রতিবাদে সেটা একটা ন্যায্য আন্দোলন বটে। তবে আন্দোলনের শিরোনাম গল্প বলার স্বাধীনতা দিয়ে ওরা আন্দোলনের ক্ষেত্র ও পরিধি একটু সীমিত করেছেন।
আরও পড়ুন: স্বাধীনতার অর্ধশতকে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অর্জন
আমার ধারণা, আমাদের সিনেমার লোকেরা এটা ইচ্ছে করেই করেছেন। গল্প বলার স্বাধীনতা কথার মধ্যে সব ধরনের সৃজনশীল কাজের স্বাধীনতা কোনো না কোনোভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়—গল্প, উপন্যাস, সিনেমা তো বটেই, কবিতা, গান, চারুকলা এবং সব ধরনের সৃজনশীল কাজে আসলে কোনো না কোনোভাবে গল্প বলাই তো। কিন্তু স্বাধীনতা তো কেবল সৃজনশীল কাজের মধ্যে সীমিত নয় আর বিঘ্নও তো কেবল গল্প বলার উপর আসছে না।
শিল্পী সাহিত্যিকরা যদি স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান না নেন তাহলে কেবল ওদের জন্য স্বাধীনতা সেটা তো নিশ্চিত করা যাবে না। চলচ্চিত্রের সেন্সরশিপ এবং সেই সাথে সংবাদপত্র, বই ও অনলাইনে লেখালেখি সবকিছুর ওপর সরকারের বা অন্য কারো নিয়ন্ত্রণ, এর মধ্যে এক ধরনের অসভ্যতা রয়েছে এবং এইরকম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা এগুলো হচ্ছে মতলববাজি অথবা মূর্খতা থেকে উৎসারিত।
সিনেমার দর্শক বা বইয়ের পাঠক হিসেবে দেখুন। কয়েকজন লোক বসে ঠিক করে দেবে দর্শক কোন সিনেমা দেখতে পারবে আর কোন সিনেমা দেখতে পারবে না অথবা পাঠক কোন বই পড়বে বা কোন বই পড়তে পারবে না, এটা কি সঠিক নিয়ম? এখানে কেউ তো নাবালক নয়।
কয়েকজন লোক বসে ঠিক করে দেবে দর্শক কোন সিনেমা দেখতে পারবে আর কোন সিনেমা দেখতে পারবে না অথবা পাঠক কোন বই পড়বে বা কোন বই পড়তে পারবে না, এটা কি সঠিক নিয়ম?
আরও পড়ুন: ব্রাজিলে সহিংসতা: অন্যদের জন্য সতর্ক সংকেত
দেশের প্রধানমন্ত্রী কে হবে সেই বিষয়ে জনগণের সিদ্ধান্ত চাওয়া হয়, কোন নীতিতে সরকার চলবে তার জন্য জনগণের ভোট চাওয়া হয়, আর সিনেমা দেখার ক্ষেত্রে এই ধরনের নিয়ম কেন? অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু কিশোরদের ক্ষেত্রে বিশেষ সুরক্ষার প্রয়োজন হয়, তার জন্য আমরা যদি সুনির্দিষ্ট নীতি মেনে ঠিক করে দিই কোন সিনেমা শিশুদের জন্যে উপযুক্ত বা কোন সিনেমা নয়, তার যুক্তি আছে। কিন্তু সেন্সরশিপ? এটা নিতান্তই অযৌক্তিক, অন্তত এই সময়ে এসে।
অযৌক্তিক বা অসভ্যতা কেন? অসভ্যতা বলছি তার কারণ হচ্ছে মানুষের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা তথা মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিঘ্ন করা তো সভ্যতা বিরোধী কাজ। সভ্যতা অগ্রসর হয় বিদ্যমান জ্ঞান প্রথা বিশ্বাস ও মূল্যবোধ প্রশ্ন করে করেই।
কোনো জ্ঞান বা কোনো সত্য বা কোনো মূল্যবোধ কোনো কিছুই সত্য বা সঠিক প্রমাণিত হয় না যদি না তা সব প্রশ্ন মোকাবিলা করে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রশ্ন করলেই যে ধারণা বা যে বিশ্বাস ভেঙে পড়ে সেটা সত্য নয়।
আরও পড়ুন: স্মার্ট বাংলাদেশ: এক নতুন রূপকথার হাতছানি
আমরা গ্যালিলিওর উদাহরণ দিই, এই পর্যন্ত মানুষের যা কিছু অর্জন সেগুলো প্রচলিত বিশ্বাস প্রথা, মূল্যবোধ ও সেই সংক্রান্ত সকল নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি উপেক্ষা করেই অর্জিত হয়েছে। এগুলো তো আমরা সকলেই জানি, এরপরেও যদি আমরা মানুষের চিন্তা ও প্রকাশে নানা রকম বাধা তৈরি করতে থাকি তাহলে তাকে অসভ্যতা না বলে কী বলা উচিত?
তারপরও নানা দেশের সরকার বা অন্যসব প্রতিষ্ঠান ওরা যে মানুষের মত প্রকাশে ও সৃজনশীলতা প্রকাশে নানাপ্রকার বিধিনিষেধ আরোপ করতে চায়, সেটা কেন করে? দুই কারণে করে। প্রথম কারণটা হচ্ছে মতলববাজি। মতলবটা হচ্ছে সমাজের বিদ্যমান ধরন বজায় রাখা।
সংখ্যাগরিষ্ঠদের পছন্দমতো সমাজ কাঠামো বজায় রাখা থেকে নিতান্ত সরকার বা একটা গোষ্ঠীর ক্ষমতা বজায় রাখা নানারকম হতে পারে এর ধরন আর তার প্রকাশ হয় সংখ্যালঘুর কণ্ঠ রোধ করার মধ্য দিয়ে। কেননা পরিবর্তনের কথা তো প্রথমে একজন ব্যক্তিই বলে। কোটি মানুষের বিশ্বাসের বিপরীতে প্রথম একজন মানুষ একটা যুক্তি নিয়ে আসে—এভাবেই তো আমরা এখানে এসেছি, নাকি?
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের সব অর্জন আওয়ামী লীগের হাত ধরেই
এখানে এসেছি মানে সভ্যতার বিকাশ এই পর্যন্ত এসেছে। অগ্রসর যতটুকু হয়েছি আমরা সেটা থেকে মানুষ শিক্ষা নিয়েছে। সেই শিক্ষার প্রতিফলন আপনি দেখতে পাবেন আধুনিক রাষ্ট্রগুলোয়। বেশিরভাগ দেশই এখন আর সিনেমার উপর কোনো কর্তৃত্ববাদী সেন্সরশিপ আরোপ করে না।
রেটিং করে সকলেই, ঐ যে বলেছি শিশু কিশোরদের জন্যে সুরক্ষার প্রয়োজন হয়, সেজন্য সিনেমার লোকেরা নিজেরাই মিলে ঠিক করে নেয় কোন সিনেমা কোন বয়সী লোকের জন্যে উপযুক্ত।
আমাদের পাশের দেশ ভারত, ওরাও সেন্সরশিপ তুলে দিয়েছে অনেক আগেই—যদিও ঐ যে মতলববাজির কথা বললাম, ওরা এখনো সুযোগ পেলেই চেষ্টা করে কণ্ঠ রুদ্ধ করার।
আমাদের দেশেও স্বাধীনতার পর আমরা যখন সংবিধান প্রণয়ন করেছি তখন কিন্তু আমরা বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা একটি নিরঙ্কুশ অধিকার হিসেবেই গ্রহণ করেছি এবং সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদে বলে দিয়েছি যে শুধুমাত্র সীমিত কিছু ক্ষেত্রে সরকার আইন দ্বারা যুক্তিসংগত কিছু বিধি নিষেধ আরোপ করতে পারে।
আরও পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাবান্ধব পরিবেশ কেন জরুরি?
দেশের প্রধানমন্ত্রী কে হবে সেই বিষয়ে জনগণের সিদ্ধান্ত চাওয়া হয়, কোন নীতিতে সরকার চলবে তার জন্য জনগণের ভোট চাওয়া হয়, আর সিনেমা দেখার ক্ষেত্রে এই ধরনের নিয়ম কেন?
আমাদের সংবিধান অনুযায়ী আপনি যে মতামত প্রকাশ করবেন বা যে গল্প বা যে ছবি বা যে শিল্পকর্ম করবেন সেটা যুক্তিসংগত হ্যাঁ অথবা না তার ওপর আপনার প্রকাশের স্বাধীনতা নির্ভর করে না। কিন্তু কেউ যদি তাতে বাধা দিতে চায় তাহলে তাকে দেখাতে হবে যে বাধা কোনো আইনের মধ্যে রয়েছে এবং সেই আইন যুক্তিসংগত কি না। আইন যদি যুক্তিসংগত না হয়, তবে সেই আইনও অবৈধ এবং সেই আইন দেখিয়ে বাধা দেওয়া সেটাও অবৈধ।
তাহলে এই যে মাঝে মধ্যেই আমরা দেখতে পাই সরকার কোনো বই নিষিদ্ধ করে দিচ্ছে বা কোনো সিনেমা সেন্সর বোর্ড আটকে দিচ্ছে সেগুলো ওরা কীভাবে করে? সরকারের বা সেন্সর বোর্ডের এইসব কাণ্ড অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবৈধ।
আরও পড়ুন: মেট্রোরেল অর্থনীতির নতুন জাগরণ
তবে কি আমরা এইরকম প্রত্যেক ক্ষেত্রে আদালতে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে আসব? আদালতের দরজা তো খোলা আছেই। কিন্তু সব ক্ষেত্রে এইরকম মামলা করে করে স্বাধীনতা নিশ্চিত করা নানা কারণে সম্ভব নাও হতে পারে।
আপনি বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানসমূহের বিরুদ্ধে একা কতটুকু লড়তে পারবেন সেটার একটা সীমা আছে। এইজন্যে মানুষের মত ও চিন্তার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্যে সামগ্রিকভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়। আন্দোলন করতে হবে সর্বাত্মক, বাক ও মত প্রকাশের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার জন্য, কোনো বিশেষ ধারা বা ক্ষেত্র বা গোষ্ঠীর স্বাধীনতা নয়—সকলের স্বাধীনতা এবং নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা।
আরও পড়ুন: শীতে যেসব রোগের তীব্রতা বাড়ে
কেবল সিনেমা নয় বা কেবল সৃজনশীল ক্ষেত্র বলে নয়, সমাজের সর্বত্র সব ব্যক্তির সব ধরনের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যে বাক স্বাধীনতা হচ্ছে বিষয়-নিরপেক্ষ ধারণা।
আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট
 
                                     
                                 
                                         
                     
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                        
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                     
                             
                             
                     
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
             
                     
                             
                             
                     
                            