মতামত

সেপ্টেম্বর ১১: ফিরে দেখা

২০০১ সালের সেপ্টেম্বর ১১, একটি ঘটনা মুহূর্তেই বদলে দিল সারা পৃথিবীকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে পরিবর্তনের সূচনা হলো, তার প্রভাব এখনো বিদ্যমান মার্কিন রাজনীতি ও সমাজে। ১১ সেপ্টেম্বর যাত্রীবাহী বিমানকে অস্ত্র বানিয়ে নিউইয়র্কে অবস্থিত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে কয়েক হাজার মানুষের জীবননাশের যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সূচনা হয়, আজ থেকে ২০ বছরে আগে, তার জের আজও চলছে। ২০ বছর আগের ঘটনাটি ঘটার পরপরই ঢাকার দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোয় কর্মরত আমার ছোট ভাই জাহীদ রেজা নূরের অনুরোধে নিউইয়র্ক থেকে পরপর তিনটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলাম, যেগুলো প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠাতেই প্রকাশিত হয়। আমার জানা মতে, আমার প্রতিবেদনগুলো সরাসরি ঘটনাস্থল নিউইয়র্ক থেকে কারও পাঠানো বাংলাদেশের কোনো জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রথম সংবাদ প্রতিবেদন ছিল! সেই প্রতিবেদনটি আমি শুরু করেছিলাম এই বাক্য দিয়ে, ‘নিউইয়র্ক আজ আর কোনো প্রীতিকর শহর নয়, নিউইয়র্ক আজ ভীতিকর শহর’!

সেই তো শুরু। রোমাঞ্চকর–দৃষ্টিনন্দন শহর মুহূর্তের মধ্যেই হয়ে গেল ভীতির শহর! নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার বাণীকে অঙ্গে ধারণ করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পত্তন হয়েছিল একদিন, সেই রাষ্ট্রব্যবস্থায় এ ঘটনার জের ধরেই মুক্ত-মানুষের অধিকারকে ক্রমান্বয়ে সংকুচিত করা হলো! প্রশ্ন উঠল: রাষ্ট্রের নাগরিকদের অধিকার না নিরাপত্তা, কোনটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে? বহু উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গিয়ে নানা তর্ক-বিতর্কের পর জাতিকে বেছে নিতে হয়েছিল, স্থান দিতে হয়েছিল ‘নিরাপত্তা’কে ‘অধিকারের’ ওপরে। ১১ সেপ্টেম্বরের পর ব্যক্তিস্বাধীনতার এ দেশে মানুষের বহু অধিকারকে ক্ষুণ্ন করা হলো—তবে, বিনা প্রতিবাদে নয়।

এ ঘটনাটি এ দেশের গণমানুষের মনে প্রচণ্ড একটি ধাক্কা দিয়ে যায়! ফলে আঘাত ও যন্ত্রণা-বোধের ঘোর কাটিয়ে উঠতেই গণমনে একটি যুদ্ধংদেহী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত নেতৃত্ব মুখ বুজে এ রকম বিশাল একটি আঘাত ও বিপর্যয়কে সহ্য করে নিতে পারছিল না বলে দেশজুড়েই মুহূর্তের মধ্যেই একটি ‘যুদ্ধ-যুদ্ধ’ পরিবেশের সৃষ্টি হতে থাকলে আরেক দল মানুষ প্রতিবাদী হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে এই ‘যুদ্ধংদেহী’ মনোভাবের পাল্টা জবাব দিতে। মনে আছে নিউইয়র্কের টাইম স্কয়ারে যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের প্রকাশ ঘটে হাজার হাজার মানুষের প্রতিবাদী সোচ্চার সমাবেশ ও মিছিলগুলোয়। যুদ্ধে যাওয়া না-যাওয়া নিয়ে তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে দেশ! ভিয়েতনাম যুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর সুবুদ্ধিসম্পন্ন মার্কিনরা আর কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়াকে দেশ ও দশের জন্য কল্যাণকর কিছু হতে পারে বলে ভাবতেই পারছিল না। তা ছাড়া, এই শত্রু মোটাদাগে, চিহ্নিত কোনো শত্রু ছিল না বলে এই অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ কোনো কাজের কথা নয় বলেই তাদের অভিমত ছিল। কিন্তু ভোটের রাজনীতির একটি হিসাব থাকে, সেখানে মানুষের ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে উদ্দেশ্য হাসিল করাটা হয়ে ওঠে রাজনীতিকদের ‘পরম-ধর্ম’।


ফলে সেই ভোটের হিসাবের মায়াজালে জড়িয়ে রাজনীতিক ও ক্ষমতাসীন কর্তাব্যক্তিরা দেশকে যুদ্ধের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়; শেষমেশ ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানে হামলার মধ্য দিয়ে ও সৈন্য পাঠিয়ে যে যুদ্ধের সূচনা করা হয়েছিল, সেই যুদ্ধ কালে কালে ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশে এবং ২০ বছর কাল পর্যন্ত সেই যুদ্ধ চালিয়েও কোনো উদ্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে কি না, সেই বিতর্ককে উন্মুক্ত রেখেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চরম সাহসিকতা দেখিয়ে এবার এই যুদ্ধের ২০ বছর পূর্তিকালেই যুদ্ধ-সমাপ্তির ‘জয়-ডংকা’ বাজিয়ে দিলেন।

এই যুদ্ধ মার্কিন জাতিকে বিভক্ত করেছে চরমভাবে! তবে মার্কিন ইতিহাস এই সাক্ষ্যই দেয় যে এ দেশে একটি ‘যুদ্ধবাজ’ চক্র যেমন বরাবর সক্রিয় আছে, তেমনি আছে একটি চরম প্রতিবাদী যুদ্ধবিরোধী গণমানবদের অংশ! এদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব বরাবরের! কে কখন যে কাকে ছাপিয়ে যাবে, সেটা সাধারণত সময় ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে! রাষ্ট্র পরিচালনায় পেন্টাগন আর স্টেট ডিপার্টমেন্ট, অর্থাৎ মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে এই বিবাদ ভীষণ রকম সক্রিয় থাকে। রিপাবলিকান পার্টি হোয়াইট হাউস দখল করলে পেন্টাগন তথা যুদ্ধবাজরা অগ্রণী ভূমিকায় এসে পড়ে। স্টেট ডিপার্টমেন্ট তথা যুদ্ধবিরোধীরা বরং কূটনৈতিক পন্থায় উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টায় রত থাকে, যখন হোয়াইট হাউসে ডেমোক্রেটিক দলের প্রেসিডেন্ট তাদের সঙ্গী হয়ে ওঠে! এ কথা ভুললে চলবে না যে মার্কিন জীবনধারায় এই যুদ্ধ হলো সবচেয়ে বড় একটি ব্যবসা! যতবারই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ততবারই গুটি কয়েক পরিবার, অর্থাৎ একটি গোষ্ঠী ফুলে ফেঁপে কলাগাছ হয়ে গেছে আর বিপরীতক্রমে সাধারণ মানুষের জীবন হয়েছে ওষ্ঠাগত, কারণ দেশের অর্থনীতি বিরাট ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে, ঝুঁকির মধ্যে দিয়ে গেছে!

এ রকম একটি পটভূমিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একেবারে লেজেগোবরে হওয়া, তালগোল পাকিয়ে যাওয়া পরিস্থিতি থেকে দেশকে উদ্ধারের মানসে একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন। হুট করেই আফগানিস্তানের যুদ্ধ-সমাপ্তির ঘোষণা দিয়ে দিলেন! বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে এটা বলাই যায় প্রেসিডেন্ট বাইডেন দেশ ও দশের কল্যাণেই এ রকম একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং দেশ ও দেশের জনগণ এর সুফল পাবে যথাসময়ে, যদি না কোনো নতুন সমস্যা ও সংকট এ পথকে বাধাগ্রস্ত করে! তবে আফগানিস্তান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে আসার পর্বটি এত বেশি শিক্ষানবিশ ধরনের ও লেজেগোবরে হয়ে গেছে যে বাইডেন প্রশাসনকে এর জন্য যথেষ্ট মূল্য দিতে হচ্ছে, অন্তত জনমত জরিপের দৌড়ে। তবু সার্বিক বিচারে বলা যায় বাইডেনের এই যুদ্ধবিরোধী মনোভাব ও সিদ্ধান্ত নতুন কোনো বিষয় নয়; বরং আজ থেকে ২০ বছর আগের যুদ্ধ-সূচনাকালীন দ্বন্দ্বেরই বহিঃপ্রকাশ বৈ কিছু নয়!

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০ বছর আগে যে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যে বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে, আজ ২০ বছর পরে এ ঘটনাধারা এ সাক্ষ্যই দেয় যে এটি কোনো কামান-বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করার বিষয় নয়, এ যুদ্ধটি আদর্শিক এবং একে মোকাবিলা করা উচিত আদর্শিকভাবেই। ধর্মের নামে মূলত তালেবান যে অধর্মের প্রচার-প্রপাগান্ডা চালিয়ে মানুষকে প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত করে চলেছে, তাদের মুখের ওপর তাদের বিকৃতি ও বিভ্রান্তিগুলো উন্মোচন করে এবং দ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হয়েই মোকাবিলা করতে হবে। এই সত্য-জ্ঞানই বুঝি
এই ২০ বছরব্যাপী যুদ্ধের থেকে মার্কিনদের মূল অর্জন!

লেখক: সেলিম রেজা নূর, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বসবাসরত সাংবাদিক।


সাননিউজ/জেআই

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

ফেনসিডিলসহ ২ মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার

মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি: মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার বৈ...

আইসিসির এলিট প্যানেলে সৈকত

স্পোর্টস ডেস্ক : বাংলাদেশের প্রথম আম্পায়ার হিসেবে আইসিসির এল...

কেশবপুরে ইফতার ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত 

আব্দুর রাজ্জাক সরদার, কেশবপুর প্রতিনিধ:

ত্রিশালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৩

মোঃ মনির হোসেন স্টাফ রিপোর্টার :...

জাহাজ উদ্ধারে সরকার অনেক দূর এগিয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ মন্তব্য ক...

ত্রাণ প্রবেশ করতে দিতে ইসরাইলকে নির্দেশ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় দুর্ভিক্ষ এড়াত...

প্রেমিককে ডেকে ফেঁসে যান অনন্যা

বিনোদন ডেস্ক: ভারতের জনপ্রিয় অভিনেত্রী অনন্যা পাণ্ডে। বাবা-ম...

প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে চলতি...

চার বিভাগে বজ্রসহ বৃষ্টির আভাস

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের চার বিভাগে ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি বা...

কাশ্মিরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১০

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারত-শাসিত জম্মু-কাশ্মিরে সড়ক দুর্ঘটনায়...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা