মতামত

সাক্ষরতা ও জীবনব্যাপী শিখন

ড. শফিকুল ইসলাম

আজ আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। এবারও এ দিবসটি পালিত হতে যাচ্ছে করোনাভাইরাসের উপস্থিতিতে। ইউনেস্কো ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে 'মানবকেন্দ্রিক পুনরুদ্ধারের জন্য সাক্ষরতা :কমে আসুক ডিজিটাল বৈষম্য।'

বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকারি-বেসরকারি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর যৌথ প্রচেষ্টার ফলে সাক্ষরতা এবং মৌলিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বিশ্বে অন্তত ৭৯ কোটি মানুষ আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী 'নিরক্ষর', যা পৃথিবীর মোট দক্ষিণ এশিয়ায় সাক্ষরতার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান মাঝামাঝি পর্যায়ে। মালদ্বীপ (৯৮ শতাংশ) এবং শ্রীলঙ্কা (৯২ শতাংশ) বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে। ভারত ও বাংলাদেশের অবস্থা একই পর্যায়ে, আর অন্য দেশগুলো কাছাকাছি অবস্থানে। বাংলাদেশে এখনও কম করে হলেও তিন কোটির অধিক মানুষ নিরক্ষর। সাক্ষরতার ক্ষেত্রে গরিব-ধনী এবং গ্রাম-শহরের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান।

সাক্ষরতার গুণমানের ক্ষেত্রেও সমস্যামুক্ত নয়। এডুকেশন ওয়াচের গবেষণায় দেখা যায়, ১১ বা তদূর্ধ্ব বয়সের মানুষের মধ্যে মাত্র ৩৭ শতাংশ পড়া, লেখা এবং গণিতের যৌথ ব্যবহারের যোগ্যতা অর্জন করেছে। অনুরূপ অবস্থা অন্যান্য ক্ষেত্রেও। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হলেও খুব কমসংখ্যক শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণির যোগ্যতা অর্জন করে। এমনকি পঞ্চম শ্রেণি শেষে অনেক শিক্ষার্থী তৃতীয় শ্রেণির সামষ্টিক যোগ্যতা অর্জনেও ব্যর্থ হয়। ফলে দেখা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয় সমাপ্তকারীদের মধ্যে যেসব শিশু-কিশোর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় না তাদের মধ্যে অনেকেই কিছু সময়ের ব্যবধানে পঠন, লিখন এবং গাণিতিক যোগ্যতা ও দক্ষতা হারিয়ে ফেলে। বয়স্ক শিক্ষা সমাপ্তকারীদের ক্ষেত্রে এ অবস্থা আরও জটিল।

'ডিজিটাল বাংলাদেশ' বিনির্মাণে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত উদ্যোগের প্রভাব শহর-গ্রামসহ জীবনের নানা ক্ষেত্রে বিস্তৃত। পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদনের ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের ব্যবহার হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যালয়ে কম্পিউটার প্রদান এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। দেশের ৪,৫০০টি ইউনিয়নে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র। তবে মাত্র ৮ শতাংশ মানুষ জনসমাগমপূর্ণ স্থানে ইন্টারনেট ব্যবহার করে।

বাংলাদেশে ৯০ শতাংশেরও অধিক গ্রামীণ পরিবারে মোবাইল ফোন আছে, যার অর্ধেক স্মার্টফোন। কিন্তু এক-তৃতীয়াংশ পরিবারে এসএমএস পাঠানো এবং ৪১ শতাংশ পরিবারের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করার যোগ্যতা রয়েছে। সাক্ষরতা, বিশেষ করে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কারিকুলামসহ শিখন অগ্রগতি মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ডিজিটাল লিটারেসি-সংক্রান্ত বিষয় অনেকটাই উপেক্ষিত। আইসিটি সম্প্র্রসারণে একদিকে সাক্ষরতা ও দক্ষতার ঘাটতি, অন্যদিকে বিদ্যুৎসহ ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। নানা পর্যায়ে যেসব বৈষম্য বিদ্যমান, সেটি সহজেই কমে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিগত তিন দশকে মৌলিক শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় তৈরি হয়েছে নতুন বিদ্যালয় এবং নতুন শ্রেণিকক্ষ, বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ের ফলে বেড়েছে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো স্থাপনের মাধ্যমে দ্রুত সম্প্র্রসারিত হয় বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম। দেশব্যাপী বাস্তবায়ন করা হয় একাধিক বয়স্ক শিক্ষা প্রকল্প। এতে অল্প হলেও উপকৃত হচ্ছে নিরক্ষর মানুষ। তবে শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা, প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে ঘাটতি এবং অর্জিত দক্ষতা ও যোগ্যতা হারিয়ে ফেলার প্রবণতা নিয়ে সংশ্নিষ্ট মহল বরাবরই উদ্বিগ্ন। কত শতাংশ মানুষ ধরে রাখতে পারছে তাদের সাক্ষরতা, তার ওপর সাম্প্রতিক সময়ে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত সম্ভবত নেই। খুব কম লোকালয় আছে, যেখানে রয়েছে সবার ব্যবহারযোগ্য পাঠাগার বা অব্যাহত শিক্ষাকেন্দ্র, যা চর্চার জন্য প্রয়োজন। নানা কারণে অধিকাংশ গ্রামীণ পরিবারে এখনও শিখনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। শিক্ষা এখনও অনেক মানুষের ক্ষেত্রে জীবনব্যাপী নয়।

দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে করোনা-পরবর্তী শিক্ষা পুনরুদ্ধারের সময়ে অনেক শিক্ষার্থী বিশেষ করে মেয়ে শিক্ষার্থী এবং গরিব পরিবারের শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে ফেরত আসার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত হতে পারে, যদি সরকারিভাবে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা না হয়। অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয় খোলার পর শ্রেণিকক্ষে ফেরত গেলেও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পারার কারণে ঝরে পড়তে পারে। ফলে বিদ্যালয়বহির্ভূত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এমতাবস্থায়, মানসম্পন্ন শিক্ষা বিস্তারসহ স্কুলবহির্ভূত শিশু, যুবক এবং বয়স্কদের জন্য শিক্ষার বিকল্প/সম্পূরক সুযোগ তৈরি অত্যাবশ্যক। অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে এসব উদ্যোগকে এসডিজি-৪ এর অন্যতম মূলনীতি 'জীবনব্যাপী শিখন'-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা বাঞ্ছনীয়। 'জীবনব্যাপী শিখন' জীবনের নানা পর্যায় (যেমন- শিশু, কিশোর, যুবা, বয়স্ক) এবং জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের সঙ্গে (যেমন- কর্মসংস্থান, পরিবার, নাগরিকত্ব এবং ব্যক্তিগত উন্নয়ন) সেতুবন্ধন তৈরি করে। অতীতে মৌলিক শিক্ষাকে জীবনব্যাপী শিখনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য তেমন কার্যকর উদ্যোগ আমাদের দেশে প্রত্যক্ষ করা যায়নি। নব্বইয়ের দশকের শেষে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর উদ্যোগে কিছুসংখ্যক গ্রামীণ শিক্ষা ও মিলনকেন্দ্র তৈরি হয়েছিল, যেগুলো বেশিদিন টেকেনি। একই সময়ে ব্র্যাক, আহ্‌ছানিয়া মিশনসহ কিছু বেসরকারি সংস্থাও নানা নামে তৈরি করেছিল সাক্ষরতাউত্তর এবং অব্যাহত শিক্ষাকেন্দ্র। এখানেও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।

২০১৫ সাল থেকে এসডিজির মূলনীতির সঙ্গে জীবনব্যাপী শিখনকে সম্পৃক্ত করা হয়। ফলে তৈরি হয় নতুন সম্ভাবনা। গতিশীলতা তৈরি হয় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও। এমন এক প্রেক্ষাপটে ২০১৮ সালে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো বিদ্যালয়বহির্ভূত প্রায় ১০ লাখ শিশুর জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এসব শিক্ষার্থী কোর্স শেষে প্রাইমারি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেতে পারে, যদি এ পরীক্ষা বহাল থাকে। যারা নানা কারণে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়বে; যারা জীবিকার জন্য কারিগরি দক্ষতার উন্নয়ন বা পরিবর্তন চায়, এমন জনগোষ্ঠীকে জীবনব্যাপী শিখন কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা দরকার। কীভাবে জীবনব্যাপী শিখনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যায়, সে জন্য প্রয়োজন কৌশলপত্র তৈরি এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

আমরা অনেক সময় প্রত্যক্ষ করি, শিক্ষা-সংক্রান্ত পরিসংখ্যানেও রয়েছে অপ্রতুলতা। যদিও ব্যানবেইস শিক্ষা-সংক্রান্ত তথ্যাদি রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রকাশের মূল দায়িত্ব পালন করে, সেখানে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা-সংক্রান্ত তথ্য অনেকটাই অনুপস্থিত। করোনাউত্তর শিক্ষা

পুনরুদ্ধার এবং তৎপরবর্তী সময়ে প্রয়োজন হবে নির্ভরযোগ্য ও পরিপূর্ণ পরিসংখ্যান। নানা ক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে গবেষণার। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিশাল কাজ। এ জন্য সরকারের নেতৃত্বে সংশ্নিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাবিদসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের যৌথ ও সমন্বিত প্রচেষ্টা অত্যাবশ্যক।

সবারই প্রত্যাশা, করোনা পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পর্যায়ক্রমে হলেও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরজা খুলে দেওয়া হোক। শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রসহ সব উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র এবং সব বিদ্যালয়ে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিচালিত হবে শিক্ষা কার্যক্রম। প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে শিক্ষার সর্বক্ষেত্রে।

লেখক: সাবেক পরিচালক, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

নোয়াখালীতে ভূমি দুস্যুর বিরুদ্ধে মানববন্ধন 

নোয়াখালী প্রতিনিধি: নোয়াখালীর কোম...

ফসলের ক্ষতি করে চলছে অবৈধ ব্যাটারি ইন্ডাস্ট্রি

কামরুল সিকদার, বোয়ালমারী (ফরিদপুর):

ভূঞাপুরে বৃষ্টির জন্য নামাজ আদায় 

খায়রুল খন্দকার, টাঙ্গাইল: প্রচণ্ড তাপদাহে জনজীবন অতিষ্ট। নেই...

গরমে বারবার গোসল করা কি ক্ষতিকর?

লাইফস্টাইল ডেস্ক: বৈশাখের শুরু থে...

আজ শেরে বাংলার ৬২তম মৃত্যুবার্ষিকী

নিজস্ব প্রতিবেদক: আজ অবিভক্ত বাংল...

হিটস্ট্রোকে একদিনেই ৬ জনের মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক: তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে হিট স্ট্রোকে আক্রা...

আইনি সেবায় মানবিকতাকেও স্থান দেয়া উচিত

নিজস্ব প্রতিবেদক: আইনি সেবা প্রদানকালে পুঁথিগত আইন প্রয়োগের...

ভূঞাপুরে বৃষ্টির জন্য নামাজ আদায় 

খায়রুল খন্দকার, টাঙ্গাইল: প্রচণ্ড তাপদাহে জনজীবন অতিষ্ট। নেই...

প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরছেন কাল

নিজস্ব প্রতিবেদক: থাইল্যান্ড সফর শেষে আগামীকাল ব্যাংকক থেকে...

ডিপিএস এসটিএস স্কুলে গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠান

নিজস্ব প্রতিবেদক: ডিপিএস এসটিএস স্কুল ঢাকার ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা