দুই দশক ধরে লাতিন আমেরিকার দেশ বলিভিয়া শাসন করছে বামপন্থী মুভমেন্ট অব সোশ্যালিজম বা এমএএস পার্টির নেতৃত্বাধীন সরকার। তবে গত রবিবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম দফার ভোটে দেশটির ভোটাররা বামপন্থী দলটিকে শক্তভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। ভোটের ফলাফল সম্ভবত দেশটির সংকটাপন্ন অর্থনীতির জন্য আরও বেশি বাজারবান্ধব নীতির পথ প্রশস্ত করছে।
রবিবার রাতে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল প্রকাশিত ভোটের প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, বলিভিয়ার মধ্যপন্থী সিনেটর রদ্রিগো পাজ ভোটের প্রাথমিক ফলাফলে ৩২ দশমিক ১৮ শতাংশ ভোট পেয়ে এগিয়ে আছেন। সেখানে বামপন্থী এমএএস পার্টির প্রার্থী এডুয়ার্দো দেল কাস্তিলো পেয়েছেন মাত্র ৩ দশমিক ১৬ শতাংশ ভোট।
৯২ শতাংশ ভোট গণনা শেষে দেখা গেছে, ২৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন বলিভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট রক্ষণশীল রাজনীতিক হোর্হে ‘তুতো’ কুইরোগা রামিরেজ।
নির্বাচনের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো প্রার্থী ৪০ শতাংশের বেশি ভোট না পাওয়ায় এবং প্রথম স্থান অধিকারকারী প্রার্থীর সঙ্গে দ্বিতীয় স্থান অধিকারকারীর ভোটের ব্যবধান ১০ শতাংশের কম হওয়ায় নির্বাচন রানঅফ বা দ্বিতীয় দফায় গড়িয়েছে। আগামী ১৯ অক্টোবর দ্বিতীয় দফার ভোট অনুষ্ঠিত হবে। পূর্ণাঙ্গ আনুষ্ঠানিক ফলাফল প্রকাশিত হবে ভোটের সাত দিনের মধ্যে।
প্রথম দফা ভোটের ফলাফল বলিভিয়ার রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ২০০৬ সাল থেকে ইভো মোরালেসের নেতৃত্বে দেশটি শাসন করছে এমএএস পার্টি। একসময় বামপন্থী জোটের ওপর তাঁর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ থাকলেও এখন তা অনেকটাই কমে গেছে।
রবিবার রাতে ভোটের প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশের পর টেলিভিশনে সম্প্রচারিত বক্তব্যে রদ্রিগো পাজ বলেন, ‘বলিভিয়ার মানুষ শুধু সরকারের পরিবর্তন চাইছে না, তারা রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন চাইছে। এটি একটি বড় জয়ের, বড় পরিবর্তনের সূচনা।’
ভোটের ফল প্রকাশের পর বলিভিয়ার বন্ডের দাম প্রায় ৩ সেন্ট বেড়ে চলতি বছরের সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। বিনিয়োগকারীরা আশা করছেন, দেশটি বামপন্থী দলের শাসন থেকে বেরিয়ে এলে অর্থনীতি আবার শক্তিশালী হয়ে উঠবে, দেউলিয়াত্ব এড়ানো যাবে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ পাওয়া সহজ হবে।
রবিবার দিনের শুরুতে হোর্হে ‘তুতো’ কুইরোগা ভোটের প্রাথমিক ফলাফল মেনে নেন এবং রদ্রিগো পাজকে অভিনন্দন জানান। কুইরোগা দ্বিতীয় দফার ভোটে জায়গা করে নিয়েছে।
অন্যদিকে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট লুইস আরসে ভোটের ফলাফল মেনে নিয়ে বলেছেন, ‘গণতন্ত্র বিজয়ী হয়েছে।’
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের দক্ষিণ আন্দিজ অঞ্চলের বিশ্লেষক গ্লায়েলডিস গনসালেস কালাঞ্চে বলেন, এই নির্বাচনকে একটি মোড় পরিবর্তনকারী নির্বাচন হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ, এবার ক্ষমতাসীন এমএএস দলের কোনো শক্তিশালী প্রার্থী ছিল না। এ ছাড়া এবার আটজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
বলিভিয়ার বেশির ভাগ মানুষ এবারের নির্বাচনে সবার আগে দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতির কথা মাথায় রেখে ভোট দিয়েছেন। চলতি বছর বলিভিয়ায় দ্রব্যমূল্য লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে। পাশাপাশি জ্বালানি এবং ডলারের সরবরাহও কমে গেছে।
গত জুনে বার্ষিক মূল্যস্ফীতি দ্বিগুণ হয়ে ২৩ শতাংশ পৌঁছায়, যা জানুয়ারি মাসের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি। দেশটির অনেক নাগরিক এখন ক্রিপ্টোকারেন্সিতে আপৎকালীন বিনিয়োগ করছেন।
বলিভিয়ার নির্বাচনের ফলাফল লাতিন আমেরিকার অন্যান্য বামপন্থী সরকারের জন্যও সতর্ক সংকেত হতে পারে। চিলিতে কয়েক মাসের মধ্যে এবং ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে কলম্বিয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
অর্থনীতিবিদ রজার লোপেজ বলেন, বলিভিয়ার অনেক মানুষ বিশেষ করে যাঁরা অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে কাজ করেন, তাঁরা জীবিকা নির্বাহে হিমশিম খাচ্ছেন।
লোপেজ আরও বলেন, বলিভিয়া এখন খাদের কিনারে। দেশে ডলার নেই। এমন অনেক দায় আছে, যা ডলারে পরিশোধ করতে হবে। ভোটাররা বুঝতে পারছেন, আগামী বছরগুলো কঠিন হতে চলেছে।
নির্বাচনে মধ্যপন্থী রদ্রিগো পাজ যে পরিমাণ ভোট পেয়েছেন, তাতে অবাক হয়েছেন বিশ্লেষকেরা। ভোটের আগে বিভিন্ন জনমত জরিপে রক্ষণশীল কুইরোগা এবং মধ্য ডানপন্থী প্রার্থী স্যামুয়েল দোরিয়া মেদিনার তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিলেন রদ্রিগো পাজ।
ব্যবসায়ী মেদিনা পরাজয় মেনে নিয়ে বলেছেন, তিনি দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে পাজকে সমর্থন দেবেন।
২০০৫ সালে ইভো মোরালেস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে বলিভিয়ায় সমাজতান্ত্রিক শাসনের যাত্রা শুরু হয়। রোববারের ভোটে তাঁর জনপ্রিয়তার নাটকীয় পতন ঘটে। একসময় আদিবাসী আয়মারা ভোটারদের কাছে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু এবার তিনি তাঁদের সমর্থনও হারিয়েছেন। মোরালেস নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও তাঁরা তাতে সাড়া দেননি।
নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি স্থিতিশীল ছিল বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। মোরালেসের সমর্থকেরা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বাধা দিতে পারে বলে আশঙ্কা থাকলেও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা বলেছেন, ভোট গ্রহণে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটেনি।
নির্বাচনের ফলাফল প্রায় দুই দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো মধ্যপন্থী ও ডানপন্থীদের জন্য সুযোগ তৈরি কর দিচ্ছে। একসঙ্গে মোট ভোটের প্রায় তিন–চতুর্থাংশ পেয়েছে তারা।
লাপাজের ৩০ বছর বয়সী খুচরা বিক্রয় কর্মী সিলভিয়া মোরালেস বলেন, ‘প্রতিবছর এই সরকারের অধীনে পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। আগে এমএএস পার্টিকে ভোট দিলেও এবার তিনি মধ্য ডানপন্থী প্রার্থীকে ভোট দেবেন।
লাপাজের ৬০ বছর বয়সী শিক্ষক কার্লোস ব্লাঙ্কো কাসাস বলেছেন, তিনি পরিবর্তনের জন্য ভোট দেবেন। এই নির্বাচন নিয়ে তিনি আশাবাদী। তিনি বলেন, ‘আমরা নতুন পথে এগোতে চাই।’