সারাদেশ

রূপলাল-প্রদীপকে মারধরে জড়িত অনেকে চিহ্নিত, গ্রেপ্তার নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক

রংপুরের তারাগঞ্জে দুই ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিও দেখে অনেকে চিহ্নিত হলেও পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। হত্যার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ এবং নিহত রূপলাল দাস ও প্রদীপ লালের পরিবারের সদস্যরা অপরাধীদের শনাক্ত করেছেন। এ ঘটনায় ছড়িয়ে পড়া তিনটি ভিডিও বিশ্লেষণ করে মারধরে জড়িত অন্তত সাতজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে।

বটতলা এলাকায় রূপলাল দাস ও প্রদীপ লালকে আটকের সময় ধারণ করা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, আটকের পর এ দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল। প্রদীপ তাঁর ভ্যানের আসনের কাছে ও রূপলাল ভ্যানের পেছনে বসা ছিলেন। একপর্যায়ে এক যুবক ক্ষিপ্ত হয়ে ‘পিটাও রুবেল ভাই, পিটাও’ বলে চিৎকার করেন। এরপর প্রদীপ লালের পেছন থেকে সাদা শার্ট পরিহিত এক যুবক তাঁর কলার টেনে ধরে ঘুষি মারেন। তিনি বালাপুর গ্রামের খলিলুর রহমানের ছেলে খায়রুল ইসলাম।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য খায়রুল ইসলামের বাড়িতে গেলে দরজায় তালা ঝুলতে দেখা যায়। তাঁর স্ত্রী আরজু বেগম বাড়ির পাশে গাছতলায় বসেছিলেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেই দিন আমার স্বামী দীঘলটারীর কৃষিকাজ করছে। বাড়ি আসার সময় গোলযোগ শুনি গেছলো। সে সামনে দাঁড়াই ছিল লোকজগুলাক বাঁচপার জন্যে। তাতে ভিডিওর ছবি উঠছে।’

ভিডিওতে দেখা যায়, ভ্যানের ওপর উঠে আবার সেখান থেকে নেমে প্রদীপ লালের সামনে আসেন আকাশি রঙের গেঞ্জি পরিহিত এক যুবক। তিনি প্রদীপকে আঘাত করতে থাকেন। তিনি বুড়িরহাট পাইকারপাড়া গ্রামের লুৎফর রহমানের ছেলে রুবেল পাইকার।

কথা বলার জন্য রুবেল পাইকারের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, বাড়ির সামনে বসে আছেন একদল লোক। এই প্রতিবেদককে দেখে সটকে পড়েন সবাই। বেশ কয়েকবার ডাকার পর রুবেলের মা আনোয়ারা বেগম পাশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বলেন, ‘একজন লোক ফোন দিয়া আমার ছেলেক ডাকে নিছে। ওয় তো লোক দুইটাক বাঁচপার জন্য ভ্যানোত উঠি চিল্লাচিল্লি করছে। তাক তো ভিডিওতে দেখা যাওছে।’

৯ আগস্ট রাত নয়টার দিকে তারাগঞ্জের সায়ার ইউনিয়নের বটতলা বুড়িরহাট এলাকায় পিটুনিতে নিহত হন উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর গ্রামের রূপলাল দাস (৪০) ও মিঠাপুকুরের ছড়ান বালুয়া গ্রামের প্রদীপ লাল (৩৫)। সম্পর্কে তাঁরা আত্মীয়। রূপলাল স্থানীয় বাজারে জুতা সেলাই করতেন আর প্রদীপ লাল ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
রুবেল পাইকারের মারধর শেষ না হতেই দৌড়ে গিয়ে প্রদীপের মাথা ও কানে ঘুষি মারতে থাকেন সাদা প্রিন্টের শার্ট পরা একই গ্রামের আশরাফুল ইসলামের ছেলে সোহাগ হোসেন। কথা বলার জন্য অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও সোহাগ হোসেনকেও বাড়িতে পাওয়া যায়নি। তাঁর বাবা আশরাফুলও বাড়িতে ছিলেন না। তবে সোহাগের মা লাভলি বেগম বলেন, ‘গ্রামের সবাই ভয়ে পালাইছে। রংপুর থাকি আমার ছেলে বাড়ি আসার পথে ওই লোক দুইটাক মাইরডাং করা দেখছে। ওই সময় ছবি ভিডিও উঠছে, কিন্তু সে তো কাকও মারে নাই।’

ওই ভিডিওতে আরও দেখা যায়, ভ্যানের ওপর পড়ে যাওয়া রূপলালকে কিল-ঘুষি মারতে থাকেন সবুজ রঙের গেঞ্জি পরা বালাপুর গ্রামের ছলি মামুদের ছেলে নজরুল ইসলাম। নজরুলের স্ত্রীর ওজিদা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী মারে নাই। আমার স্বামী দেখপার গেইছে, তাতে ভিডিওত উঠছে। সবাই ভয়ে পালাইছে। ওই জন্যে ওয়ও বাড়িত নাই।’

এ ছাড়া ভিডিওতে স্থানীয় বাসিন্দা এবাদত হোসেন, আশরাফুল ইসলাম, মেহেদী হাসানকে মারধরে অংশ নিতে দেখা যায়।

৯ আগস্ট রাত নয়টার দিকে তারাগঞ্জের সায়ার ইউনিয়নের বটতলা বুড়িরহাট এলাকায় পিটুনিতে নিহত হন উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর গ্রামের রূপলাল দাস (৪০) ও মিঠাপুকুরের ছড়ান বালুয়া গ্রামের প্রদীপ লাল (৩৫)। সম্পর্কে তাঁরা আত্মীয়। রূপলাল স্থানীয় বাজারে জুতা সেলাই করতেন আর প্রদীপ লাল ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

রংপুরের তারাগঞ্জে গণপিটুনির আগে হাত জোড় করে এভাবে বাঁচার আকুতি জানান প্রদীপ লাল (বাঁয়ে)। নিজের পরিচয় বলছিলেন রূপলাল (ডানে)
রংপুরের তারাগঞ্জে গণপিটুনির আগে হাত জোড় করে এভাবে বাঁচার আকুতি জানান প্রদীপ লাল (বাঁয়ে)। নিজের পরিচয় বলছিলেন রূপলাল (ডানে)ছবি: ভিডিও থেকে সংগৃহীত
রূপলালের ছেলে জয়দাস বলেন, ‘ভিডিও দেখে প্রতিবেশীদের কাছে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি, বুড়িরহাট এলাকার মিজানুর রহমান, এবাদত হোসেন, আশরাফুল ইসলাম, মেহেদী হাসান, মোহাম্মদ আলী, সোহাগ হোসেন, রুবেল পাইকার, নজরুল ইসলাম, খাইরুল ইসলাম, শরীফুল ইসলাম, আলামিন হোসেন, রফিকুল ইসলাম, আখতারুল ইসলামসহ ২৫-৩০ জন লোক আমার বাবাকে ৯ আগস্ট রাত ৯টায় এলোপাতাড়ি মারধর করেছে। শত শত লোক তা চেয়ে দেখেছে, ভিডিও করেছে, কেউ রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি।’ তবে শনাক্ত হওয়া ওই ব্যক্তিদের স্বজনেরা দাবি করেছেন, কেউ ঘটনা দেখতে, কেউ বাঁচাতে, কেউ ভিডিও করতে গিয়েছিলেন। রূপলাল ও প্রদীপকে তাঁরা মারেননি।

মিজানুর রহমানের মা মরিয়ম বেগম ও এবাদত হোসেনের স্ত্রী রেশমা বেগম বলেন, মিজানুর ও এবাদত নির্দোষ। চোর ধরা পড়েছে শুনে তাঁরা দেখতে গিয়েছিলেন। আশরাফুল ইসলামের ভাবি শারমিন বেগম বলেন, ‘আশরাফুল অন্যায় কোনো কাজ করে না। চিল্লাপাল্লা শুনে সেদিন দেখতে গেছিল। অন্য মানুষ ভিডিও করবার সময় রূপলালের মাথা ভাসে ধরবার কছলো যাতে রূপলালকে মানুষ ভিডিওতে দেখে চিনতে পারে। ওই জন্য রূপলালের মাথা দুই হাত দিয়ে ভাসে ধরছিল। ওয় তো রূপলালকে মারে নাই।’

অভিযুক্ত মেহেদী হাসানের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর বাবা ঈশা মামুদও বাড়িতে নেই, ঘরে তালা ঝুলছে। মেহেদীর খালা রশিদা বেগম বলেন, ‘ভিডিও তো আছে। ওটে ভালো করি দেখ। লোক দুইটাক মেহেদী বাঁচার চেষ্টা করোছে। কিন্তু ওয় এখন পুলিশের ভয়ে বাড়ি ছাড়া।’

চরম বর্বরতা দেখিয়ে, উল্লাস করে রূপলাল ও প্রদীপকে হত্যা করা হয়
ঘরের ভেতরে বসেছিলেন মোহাম্মাদ আলীর মা মাহমুদা বেগম। চোখে–মুখে চিন্তার ভাঁজ। এই প্রতিবেদককে দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলেন, ‘মোর বেটা ভাঙড়ির ব্যবসা করে। সৈয়দপুরোত ভাঙড়ি বেচে বাড়ি আইসার সময় গন্ডগোল শুনে ওটে গেইছে। লোক দুইটাক মারাডাংগা করে নাই। হামার দুষমোনেরা মোর ছেলেটার দোষ দেওছে।’

অভিযুক্ত শরীফুল ইসলামকেও বাড়িতে পাওয়া যায়নি। ঘটনার পর তিনি পালিয়েছেন। তাঁর খালা সালমা বেগম বলেন, ‘শরীফুলের বাবা মোফাজ্জল হোসেন অনেক দিন আগোত মারা গেইছে। তখন থাকি বুড়িরহাট স্কুলের পেছনে থাকে। খুব ভালো ছেলে ওয়। অন্য মানুষ ওক ফাঁসার চেষ্টা করোছে।’ আলামিন হোসেন ও রফিকুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। ঘরে তালা ঝুলছে। আখতারুলের ছেলে ওমর সানি বলেন, ‘আমার বাবা নির্দোষ। ঘটনার সময় বাড়িতে ছিল। পুলিশ কী কারণে বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে, বুঝতে পারছি না।’

‘বুড়িরহাটের মানুষ আমার নির্দোষ স্বামীক মারি ফেলাল’
রবিবার সকালে রূপলালের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মেঝেতে বসে আছেন স্ত্রী ভারতী দাস। ঘটনার ১০ দিন পরও তাঁর চোখ লাল, গলা ভাঙা। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘বুড়িরহাটের মানুষ আমার নির্দোষ স্বামীক মারি ফেলাল। মেয়েটার বিয়ে পিছাইলো। স্বামী ছাড়া সংসার চালানোর কেউ ছিল না। আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই আমার এই রকম হবে। কখনো ভাবি নাই ছেলেমেয়েকে নিয়া এই পর্যায় আসতে হবে।’

রূপলালের মা লালিচা দাস বলেন, ‘বাবা আমার ছেলেটা এনা পানি খাবার চাইলো, তা–ও দেয় নাই। সবাই মিলি মারি ডাঙ্গে চাওয়াটাক মারি ফেলাইছে। বুড়িরহাটের মানুষ আমার ব্যাটাটাক মারি ফেলাইছে। ভিডিওতে তো তাক স্পষ্ট দেখা যাওছে। তা–ও পুলিশ ধরোছে না।’

এ বিষয়ে তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ ফারুক বলেন, আসামিদের শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁদের ধরতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হচ্ছে। যাদের শনাক্ত করা হয়েছে, তারা এলাকার বাইরে পালিয়ে যাওয়ায় গ্রেপ্তার করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতিমধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

সাননিউজ/এসএ

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

মাই টিভির চেয়ারম্যান নাসির ৫ দিনের রিমান্ডে

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে আসাদুল হক বাবু হত্যা মামলায় বেসরকারি টিভি চ্যানেল মাই ট...

প্রকৃতি ও পানির প্রতি আমাদের সদয় হতে হবে : প্রধান উপদেষ্টা

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২৫-এর উদ্বোধন...

সীমানা পুনর্নির্ধারণে শুনানি ২৪-২৭ আগস্ট

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণে আগা...

 এশিয়া কাপ হকিতে আমন্ত্রণ পেল বাংলাদেশ

ভারতে অনুষ্ঠিতব্য হকি এশিয়া কাপে সুযোগ পেল বাংলাদেশ। পাকিস্তান আসর থেকে নাম প...

যুদ্ধ বন্ধে ইউক্রেনকে ক্রিমিয়ার আশা ছাড়তে হবে, ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না: ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জে...

বনানির সিসা বারে রাব্বি হত্যায় দোষ স্বীকার করে মুন্নার জবানবন্দি

ঢাকার বনানী এলাকার ‘সিসা বারে’ ছুরিকাঘাতে রাহাত হোসেন রাব্বি হত্য...

সিলেটে একদিকে উদ্ধার, অন্যদিকে চলছে হরিলুট

সিলেটের ভোলাগঞ্জের সাদাপাথরে নজিরবিহীন লুটপাটের পর প্রশাসনের কঠোর অভিযানে উদ্...

বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায় ইইউ

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য সহায়তা করবে বলে জা...

ডাকসু তে ২৮ পদে লড়তে চান ৬৫৮ প্রার্থী, 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহে...

নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সহযোগিতা করবে সেনাবাহিনী

দেশ এখন নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠা...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা