মতামত

প্রাণ, ঈদ এবং কঠোর বিধিনিষেধ

রণেশ মৈত্র

ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ আসন্ন। বাঙালির ঐতিহ্য পরিবার-পরিজন এবং যতটা সম্ভব আত্মীয়-স্বজন একত্রে জমা হয়ে ঈদ উদ্যাপন করা। মানসিকভাবে মানুষ দেশের সর্বত্র প্রস্তুতি নিতেও শুরু করেছেন।

কে কোথায় যাবেন-কোথায় ঈদ করবেন, সাধ্যানুযায়ী কে কয়টা কোরবানি দেবেন বা কার কার সঙ্গে ভাগে কোরবানি দেবেন-এগুলোই সবার মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। যিনি যেমন পারবেন, তিনি তেমন বাজেটও তৈরি করে ফেলেছেন।

আর একটি অংশ আছেন-যারা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। ভাবছেন, করোনার যে প্রকোপ এবং যানবাহনের যে দুর্দশা দেখা যাচ্ছে এমন পরিস্থিতিতে তারা কর্মস্থল ছেড়ে গ্রামমুখী হবেন কিনা। তবে গ্রামে ফিরবার আকাক্সক্ষাই বেশি।

তৃতীয় আরও একটি অংশ আছেন যারা চূড়ান্তভাবে তাদের মনস্থির করে ফেলেছেন। তাদের সিদ্ধান্ত তারা এই ভয়াবহ মহামারী ও যাত্র সংকটকে অগ্রাহ্য করে তারা এবার গ্রামমুখী হবেন না। যারা যার কর্মস্থলে থেকেই তারা ঈদ উদ্‌যাপন করবেন।

যে জুলাই মাসে এবারের ঈদ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে-সেই জুলাই আসতে না আসতেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে দৈনন্দিন মৃত্যুর সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়েছে। ইতোমধ্যে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ১৫,০০০ ছাড়িয়েছে-আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখে পৌঁছেছে। উদ্বেগের বিষয় হলো-এই দুটি সংখ্যা প্রায় প্রতিদিনই হু হু করে বেড়েই চলেছে।

প্রায় দেড় বছর হলো করোনাভাইরাস সারা পৃথিবীকে এক প্রচ- অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে। কবে কে বিদায় নেবেন, সেই চিন্তায় বিশ্বব্যাপী মানুষ অস্থির। এই ভাইরাসের বিষাক্ত আঘাতে বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ দেশের স্মরণীয়-বরণীয় অনেককে ইতোমধ্যেই হারিয়েছি।

বিলম্বে হলেও, বাংলাদেশ সরকার বিগত ১ জুলাই থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত কঠোর লকডাউন ঘোষণা করে অফিস আদলত, গাড়ি-দোকানপাট, পথে-ঘাটে বিনা প্রয়োজনে লোক চলাচল কড়াকড়িভাবে তা প্রয়োগও করছেন।

এই ধরনের লকডাউন জুলাই মাস পর্যন্ত কড়াকড়িভাবে চালু রাখা এবং ৭ জুলাই থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত তা বর্ধিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা প্রয়োজন। বর্তমানে চালু রাখা কলকারখানা, হোটেল, বিমান সার্ভিসগুলোও এই সময়কাল পর্যন্ত বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়াও প্রয়োজন।

প্রস্তাব অনুযায়ী লকডাউনের মেয়াদ ৩১ জুলাই পর্যন্ত বাড়ালে ঈদের কী হবে, এমন প্রশ্ন উত্থাপন করে ধর্মীয় আবেগ সৃষ্টি করে তার বিরোধিতা করে সরকারকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা নিতে পারেন। এই আবেগপূর্ণ বিষয়টির সম্পর্কে আমার পক্ষে খানিকটা ঝুঁকিপূর্ণ অন্তত: কেউ কেউ তেমনটাই মনে করতে পারেন। কিন্তু মানুষ বাঁচানোর স্বার্থে সব ধরনের আবেগ মুক্ত হয়েই জাতির কল্যাণ কামনাকে মূল লক্ষ্য হিসেবে ধরে আলোচনা করা অত্যন্ত প্রয়োজন।

বিগত তিনটি ঈদের (করোনাকালের) অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতেই হবে। সেই করুণ অভিজ্ঞতা হলো-লাখে লাখে মানুষ ঢাকা ও অন্যান্য কর্মস্থল থেকে সব বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে গ্রামাঞ্চলে ছুটেছেন। অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করে এক সপ্তাহের মধ্যেই অনুরূপভাবে লাখে লাখে কর্মস্থলে ফিরেছেন।

প্রতিবারই এই ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণের প্রায় দু’সপ্তাহ পর থেকে করোনায় আক্রান্ত এবং তাতে করুণ মৃত্যুর ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এবারকার আসন্ন ঈদেও যদি ওই একই প্রকারের লাখে লাখে মানুষ গ্রামে ছুটতে থাকেন-সংক্রমণ ও মৃত্যু আরও বাড়বে।

মনে রাখা দরকার, হজ উপলক্ষে এভং অন্যবিধ কারণে কোন বিদেশিকেই সৌদি আরবে ঢুকতে দেবে না সৌদি সরকার। গত বারও তারা হজব্রত পালনে কাউকে যেতে দেননি সে দেশে। এই কঠোরতা শুধু করোনার কারণেই।

যারা লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধি বা তা চালু রাখার বিরোধিতা করছেন-তাদের মধ্যে শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, পরিবহন মালিক শ্রমিক, হোটেল মালিক কর্মচারীরা প্রধান। গার্মেন্ট মালিক ও বিভিন্ন চেম্বার অব কমার্স বলতে শুরু করেছে, লকডাউনে কোন সমাধান হবে না।

কিন্তু তারা কি বলতে পারবেন করোনার কারণে পৃথিবীর নানা দেশে আরও কঠোর এবং দীর্ঘমেয়াদি লকডাউন ঘোষণা করছে কোথাও কোথাও জরুরি অবস্থা ঘোষণা করছে আবার কোথাও কোথাও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বা অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইনও জারি করছে।

ওইসব দেশ তাতে ফলও পেয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে মাত্র কয়েকজন করোনা আক্রান্ত হওয়ায় দুই সপ্তাহের জন্য কড়া লকডাউন ঘোষণা করে বাড়ির বাইরে বেড়োনো পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং মানুষ তা নির্বিবাদে মেনে চলেছে।

ফলে করোনা সেখানে নিয়ন্ত্রণে আছে। রোগটি মারাত্মক রকমের ছোঁয়াছে-বলেই যত বেশি সম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন কোন মৃত্যু নেই দীর্ঘদিন-৪ জুলাই বিকেলে সিডনি থেকে বড় ছেলে জানালো বিগত ২৪ ঘণ্টায় মাত্র ১৮ জন সংক্রমিত হয়েছেন বলে সরকারিভাবে জানান হয়েছে।

এ কথা ঠিক চিরকালের জন্য কোন দেশেই লকডাউন দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। যাতে সংক্রমণ না বেড়ে ক্রমশ কমে আসে তার জন্যে ব্যাপকভাবে ভ্যাকসিনেশন প্রয়োজন। সংসদে সম্প্রতি ভাষণ দিতে গিয়ে সংসদ নেতা জানিয়েছেন, মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগকে টিকার আওতায় আনা হবে। এই দাবি সত্যে পরিণত হোক এবং তার জন্য দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োজনানুযায়ী ভ্যাকসিন পৃথিবীর নানাদেশ থেকে আনার ব্যবস্থা করা।

এ কথা অনেকেরই জানা যে এই পৃথিবীর মধ্যে করোনা চিকিৎসার ব্যাপারে সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবা সর্বাধিক অগ্রসা। সেখানে সংক্রমণ ও মৃত্যু অত্যন্ত কম। তারা বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিন নিজেরা প্রস্তুত করেছে যার ব্যবহারও তারা ব্যাপকভাবে করছে।

বাংলাদেশ সরকার দ্রুত কিউবার সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করলে যথেষ্ট ইতিবাচক ফল ফলবে বলে মনে হয়। এ ছাড়া চীন, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড প্রবৃতি দেশও করোনা নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছে। তাদের কাছ থেকেও আমরা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারি-কেউ কেউ ভ্যাকসিন ও সরবরাহ করবে যদি আমরা যথাযথভাবে চুক্তির শর্তগুলো মেনে চলি।

করোনা নিয়ন্ত্রণে লকডাউন, ব্যাপক ভ্যাকসিনেশন ছাড়াও দেশের সব সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে পিসিআর ল্যাব স্থাপন, প্রতি জেলায় কমপক্ষে ২০টি করে আইসিইউ বেড স্থাপন ও যথেষ্ট পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহের দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে পালন করতেই হবে। জানা যায়, করোনার দেড় বছর পরও দেশের ৩৫টি জেলার সরকারি হাসপাতালে আজও আইসিইউর ব্যবস্থা নেই। এমন অবস্থা আর কোন দেশে কল্পনাও করা যায় না।

ঈদ প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এখন গ্রামাঞ্চলেও করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই সর্বোচ্চ সতর্কতার বিকল্প নেই। লকডাউনের মেয়াদ ৩১ জুলাই পর্যন্ত বৃদ্ধি, কোরবানি পকুর হাট নয়-অনলাইনে তা কেনাবেচা, কাঁচাবাজার এবং অন্যান্য বাজারগুলো ছোট ছোট আকারে ভাগ করে বিভিন্ন মাঠে ছড়িয়ে দেয়া।

ঈদের জামায়াত কোন মাঠে নয়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে তা দফায় দফায় মসজিদগুলোতে আয়োজন করা হোক। এভাবেই আমরা এবারের ঈদকে মানুষ বাঁচানোর ঈদে পরিণত করতে পারি-আর কোন বিকল্প পথ নেই।

[লেখক : সভাপতিম-লীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ]

সান নিউজ/এমএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

মফস্বল সাংবাদিক ফোরামের ১১০ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন

মফস্বল ও প্রান্তিক পর্যায়ে কর্মরত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, হামলা, হ...

মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে স্বতন্ত্রসহ চারজনের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ

মুন্সীগঞ্জে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীসহ চারজন প্রা...

নাসার চাঁদে অভিযানের দায়িত্বে স্পেসএক্স না ব্লু অরিজিন?

পরবর্তী চাঁদ অভিযান কর্মসূচিতে কোন প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা হবে নাসার নতুন প্রশ...

নোয়াখালীতে বিএনপির কার্যালয়ে আ. লীগের হামলা, আহত ৪

নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়াতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপির কার্যাল...

বাজারে কৃত্রিম সার সংকট সৃষ্টির অপরাধে ব্যবসায়ীকে জরিমানা

বাজারে কৃত্রিম সার সংকট সৃষ্টির অপরাধে কুষ্টিয়ার মিরপুরে এক ব্যবসায়ীকে জরিমান...

আলফাডাঙ্গা কলেজে পরীক্ষা চলাকালে অস্ত্র হাতে মহড়া, গ্রেপ্তার যুবক

ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা আদর্শ কলেজে স্নাতক সম্মান (ডিগ্রি) পরীক্ষা চলাকালে দেশীয়...

মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে স্বতন্ত্রসহ চারজনের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ

মুন্সীগঞ্জে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীসহ চারজন প্রা...

চাকসুর উদ্যোগে ইসলামী ব্যাংক–চবি’র কর্পোরেট চুক্তি

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি কর্পোরেট...

সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর ঝালকাঠিতে সড়ক অবরোধ প্রত্যাহার

ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার সন্তান সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগঠন ‘ইনকিলাব ম...

বাজারে কৃত্রিম সার সংকট সৃষ্টির অপরাধে ব্যবসায়ীকে জরিমানা

বাজারে কৃত্রিম সার সংকট সৃষ্টির অপরাধে কুষ্টিয়ার মিরপুরে এক ব্যবসায়ীকে জরিমান...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা