মতামত

আসল সমস্যাটা কারখানার ভেতরে নয়, বাইরে

ফারুক ওয়াসিফ

পুড়ে কয়লা হওয়া ৫২টি লাশ মাটিচাপা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার মাথা তুলবে উটের মাথার মতো উঁচু উন্নয়ন। তার আগে রূপগঞ্জের সজীব ফুডসের আগুনে দেখা সত্যগুলো আবার তুলে ধরা যাক। কারখানাটি চলত মূলত শিশুশ্রমে। নিখোঁজ, নিহত ও আহতদের মধ্যে বড় একটা অংশই ১৮ বছরের নিচে। একসঙ্গে কাজ করতেন মা ও কন্যা, পিঠাপিঠি বোন ও ভাই। কিশোরগঞ্জের মেয়েরাই ছিল বেশি। ভোলা জেলা থেকেও এসেছে অনেকে। শ্রমিকদের একটা অংশ এই করোনার সময়ে কাজ নিয়েছে। অভাবে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে অনেকের। স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুরা কোথায় যায়, তার উত্তর এই পোড়া লাশগুলো।

কেবল কি সজীব গ্রুপের হাসেম ফুডসে তারা কাজ করত? গত শুক্র ও শনিবার দুই দিন গিয়ে দেখেছি, কারখানা ছুটির সময় রাস্তার দুই পাশে যে হাজারো নারী শ্রমিক হেঁটে যান, তাঁদের বড় অংশটাই ১৮ বছরের কম বয়সী। সরকারি কর্তৃপক্ষ চাইলে যেকোনো সময় নারায়ণগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ, রূপগঞ্জ কিংবা সাভার-আশুলিয়ার শ্রমঘন কারখানাগুলোতে অভিযান চালিয়ে দেখতে পারে। এমনকি ছুটির সময়ে কারখানার দরজায় দাঁড়িয়েও গুনে নিতে পারে কতজন অপ্রাপ্তবয়স্ক।

এবার পাঠক, আপনি এসব কিশোরীর ওজন আর উচ্চতাটুকুই মাপুন। অন্তত চোখের আন্দাজে হিসাব করুন। বেশির ভাগেরই উচ্চতা ৫ ফুটের নিচে। দারিদ্র্যের অন্যতম প্রধান উপহার হলো অপুষ্টি। অপুষ্টিতে তারা ঠিকমতো বাড়তে পারে না।

এসব স্কুল থেকে ঝরে পড়া, অপুষ্ট খাটো কিশোরীরা যেসব ভবনে কাজ করে, তা খুব উঁচু। এসবের ফটকে লেখা থেকে ‘শিশু শ্রমিক নেওয়া হয় না’। হাসেম ফুডসেও ছিল। ‘কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়’ বলে খালাস পেতে পারে না সরকার। তাঁরা ভালো করেই জানেন, শিশুশ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অনেক শিল্পের সৌধ। আর সেসবের মালিকদের অনেকেই সংসদ, মন্ত্রণালয়, ক্ষমতাসীন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আলো করে আছেন। নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল মারবেন না তাঁরা। কারখানা পরিদর্শকেরা তাই দপ্তরে বসে বেতন তোলেন। আর পোড়া কারখানার শ্রমিকেরা মাসের ৮ তারিখে বকেয়া বেতন, বোনাস আর ওভারটাইমের টাকা না পেয়েই মরে যান।

সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রই নাগরিকদের জীবন-মৃত্যুর দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যানেজার বা ব্যবস্থাপক। বাঁচার অধিকার, কাজ করলে মজুরির অধিকার, নিরাপদ কর্মস্থলের অধিকারের কথা সংবিধানের পাতা থেকে আপনা-আপনি বাস্তবায়িত হবে না। তা বাস্তবায়নের তদারকির দায়টা রাষ্ট্রের। এই ব্যবস্থাপনার জন্যই রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠান কায়েম করা আছে। রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার কাজ করে সরকার ও প্রশাসন। তাদের ব্যবস্থাপনার গুণে গ্রামের মানুষের উচ্চতা কমে যাচ্ছে আর শহরে উঁচু উঁচু ভবন উঠছে। কারখানা নামের সেসব ভবনে সেকশন অনুযায়ী গ্রিলের খাঁচা থাকে, কেঁচি গেট থাকে, কাজের সময়ে সেসবে তালা দেওয়া থাকে। এ রকম খোঁয়াড়ের মতো পরিবেশে কয়েক হাজার টাকার জন্য কখন জীবন সঁপে দেয় মানুষ? যখন তারা নিরুপায় হয়।

গ্রামে নিরুপায় হয়ে তারা শহরে আসে। শহরে যেসব বস্তিতে থাকে, সেটা মানুষের যোগ্য হওয়ার কথা নয়। হাসেম ফুডসের ওই কারখানার পেছনের এলাকার নাম গোলকান্দাইল ৫ নম্বর ক্যানেল। পুরো এলাকা ছয় মাস ধরে পানিতে ডুবে আছে। বর্ষার পানি নয়, আশপাশের কারখানাগুলোর বিষাক্ত পানি। বয়স্করা হাঁটুপানিতে চলাচল করেন, কোমরপানিতে খেলাধুলা করে শিশুরা। ছয় মাস তো কেউ ঘরের চৌকিতে বসে থাকবে না। অনেকের ঘরের ভেতরেও পানি। এই পানি তাদের পা খেয়ে ফেলে। পায়ের তালুতে ছোট ছোট গর্ত দেখা যায়।

কারখানা নামের সেসব ভবনে সেকশন অনুযায়ী গ্রিলের খাঁচা থাকে, কেঁচি গেট থাকে, কাজের সময়ে সেসবে তালা দেওয়া থাকে। এ রকম খোঁয়াড়ের মতো পরিবেশে কয়েক হাজার টাকার জন্য কখন জীবন সঁপে দেয় মানুষ? যখন তারা নিরুপায় হয়।
এই জীবন প্রায় দাসসুলভ। যাদের মৌলিক অধিকার নেই, তারা স্বাধীন নাগরিক নয়। মধ্যযুগীয় দাসব্যবসায়ী রাষ্ট্রগুলোতে স্বাধীন নাগরিক আর দাসদের জন্য আলাদা আইন থাকত। দাসদের হত্যায় মালিকের কোনো অপরাধ হতো না। আমাদের রপ্তানিমুখী শিল্পের কতভাগ শ্রমিক এই দশায় আছে? কোন কোন মৌলিক অধিকার তারা পায়? মৌলিক বৈষম্য যেখানে থাকে, সেখানে নৃশংসতা খুবই স্বাভাবিক। নিয়মিতভাবেই তা ঘটে।

আমরা শিল্পায়ন চাই। চাই কারখানাগুলো লাভ করুক, রপ্তানি করুক এবং টিকে থাকুক। কিন্তু বারবার রানা প্লাজা, বারবার তাজরীনের আগুন একে টেকসই করবে না। সস্তা শ্রমের জোগানের ব্যবস্থা রাষ্ট্র না হয় করল, কিন্তু এ পদ্ধতিতে বেশি দূর এগোনো যায় না। আরও সস্তায় শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে আফ্রিকায়। যদি সত্যিই দেশ মধ্যম আয়ের স্তরে ওঠে, তাহলে স্কুল থেকে শিশু শ্রমিক টেনে নিয়ে আসার অর্থনৈতিক প্রণালিটা বন্ধ হবে। মজুরি ও কাজের পরিবেশ তখন উন্নত করতেই হবে। এ কারণে উন্নয়ন আর শ্রমদাসত্ব সাংঘর্ষিক। কিন্তু এটা কেতাবের কথা। বাস্তবে ওদিকে উত্তরবঙ্গ, এদিকে ময়মনসিংহ আর সেদিকে বরিশাল টু ভোলার চরাঞ্চলকে দরিদ্র করে রাখতে হবে। একশ্রেণির তরুণদের সেটুকু সুযোগ দেওয়া হবে, যাতে তাঁরা প্রবাসে শ্রমদাসত্বের যোগ্য হয়ে রেমিট্যান্স আনতে পারেন। তার নিচে আরেকটা অংশকে ঠেকিয়ে রাখা হবে, যাতে তারা শিশু শ্রমিকের খাতায় নাম লেখায়।

এটা করতে বেশি বুদ্ধি লাগে না। একদিকে চালের দাম বাড়িয়ে রাখা হবে, অন্যদিকে কৃষকের ধানের দাম কখনোই ন্যায্য সীমায় যাবে না, ব্যস! এ হলেই অনেক গরিব দিন চালাতে হয়রান হবে। তারপরে থাকবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় কম বরাদ্দ। কতজনকে দেখেছি, পরিবারের কারও চিকিৎসা চালাতেই জমিজমা বেচে স্রেফ ভূমিহীন হয়ে গেল!

রাষ্ট্রযন্ত্রকে যাঁরা চালান, সেই সরকার এ ব্যাপারে সতর্ক। এখানকার সস্তা শ্রমের সরবরাহ লাইন অটুট রাখা, কারখানাগুলোর ভেতরের অমানবিক বাস্তবতা চলতে দেওয়া ও লুকিয়ে রাখা এবং বড় বিপর্যয় হলে শুভংকরের ফাঁকি দিয়ে সামলানো; এটাই তাদের ব্যবস্থাপনার কৌশল। এই কৌশলে রানা প্লাজার হাজারো লাশ খরচযোগ্য তালিকায় স্থান পেয়েছে। হাসেম ফুডসের ৫২টি লাশ তার কাছে তুচ্ছ। সমস্যাটা তাই কারখানার ভেতরে নয়, তার শিকড় বাইরে এবং রাষ্ট্র-রাজনীতি ও অর্থনীতির অনেক গভীরে। গরিব মানুষ মৃত্যু দিয়ে কথা বলে। তাদের পোড়া দেহগুলো ততটাই বীভৎস, যতটা বীভৎস এই লাশের ম্যানেজারি।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক

[email protected]

সান নিউজ/এনএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে আওয়ামী লীগের শাস্তির দাবি ইবি বৈছাআ'র

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ইন্তেকালে গভীর শোক ও বিনম্র...

গজারিয়াতে কোস্ট গার্ডের অভিযানে ৪৩ লাখ টাকার জাটকা জব্দ

মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় কোস্ট গার্ডের বিশেষ অভিযানে প্রায় ৪৩ লাখ টাকার জ...

বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে দেশজুড়ে শোকের ছায়া

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আর নেই। (ইন্না লিল্...

মুন্সীগঞ্জে সেনাবাহিনীর অভিযানে ককটেলসহ ৩ জন আটক

মুন্সীগঞ্জ সদরের চরাঞ্চলের মোল্লাকান্দি ইউনিয়নের নতুন আমঘাটা গ্রামে সহিংসতা ও...

স্মরণকালের রেকর্ডসংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণে খালেদা জিয়ার জানাজা সম্পন্ন

জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম...

ঝালকাঠিতে খালেদা জিয়ার গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত

ঝালকাঠির জেলা বিএনপির উদ্যোগে বেগম খালেদা জিয়ার গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছ...

রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় খালেদা জিয়ার দাফন সম্পন্ন

বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চ...

মরহুমা কারও থেকে ঋণ নিয়ে থাকেলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন: তারেক রহমান

জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম...

স্মরণকালের রেকর্ডসংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণে খালেদা জিয়ার জানাজা সম্পন্ন

জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম...

মায়ের জন্য দোয়া চাইলেন তারেক রহমান

লাখো মানুষের অংশগ্রহণে বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জ...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা